ভারতে এবার বাংলা নববর্ষ পালিত হচ্ছে শুক্রবার, ১৫ই এপ্রিল। সেই বাংলা সনের সূত্রপাত যে একজন হিন্দু রাজার হাত ধরে, সেই বক্তব্য নিয়েই জেলায় জেলায় প্রচার শুরু করছে আরএসএস প্রভাবিত ‘বঙ্গীয় সনাতনী সংস্কৃতি পরিষদ’।
কলকাতায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাংস্কৃতিক শাখা আইসিসিআর-এর যে সেন্টারটি রয়েছে, তার মিলনায়তনে এই উপলক্ষে নববর্ষের দিন একটি প্রদর্শনীরও আয়োজন করেছ ওই সংগঠনটি।
১৪ই এপ্রিল দেশে দেশে যেভাবে বর্ষবরণ উৎসব উদযাপিত হয়
ওই প্রদর্শনীটির নামকরণ করা হয়েছে ‘শশাঙ্ক থেকে বর্তমান’।
কিন্তু কেন হঠাৎ রাজা শশাঙ্ককেই বঙ্গাব্দ’র প্রবর্তক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার এই উদ্যোগ?
পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএসের তাত্ত্বিক নেতা ও পরিচিত মুখ জিষ্ণু বসু বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে আকবরই বাংলা সাল গণনার রীতি শুরু করেছিলেন।”
“কিন্তু বিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদদের আধুনিক গবেষণা দেখিয়ে দিচ্ছে যে নানা কারণে আকবরের পক্ষে বঙ্গাব্দ চালু করা সম্ভবই নয়।”
তিনি বলেন, “আবুল ফজলের প্রশাসনিক আকরগ্রন্থ আইন-ই-আকবরীতেও বহু সালতামামি আছে, কিন্তু সেখানেও বঙ্গাব্দের কোনও উল্লেখই নেই।”
“আকবরের জীবদ্দশায় তিনি বাংলার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কখনোই পাননি, ১৫৭৬-য়ে রাজমহলের যুদ্ধ জিতে মুঘলরা প্রথম বাংলা দখল করলেও তারপরও বহু বছর ধরে যুদ্ধ চলেছিল।”
“আর বেছে বেছে সেই অস্থির বাংলাতেই আকবর একটা নতুন সাল চালু করবেন, সেটা খুব অস্বাভাবিক”, বলছিলেন ড. বসু।
শশাঙ্ক বনাম আকবর
বঙ্গাব্দ’র প্রবর্তক হিসেবে হিন্দুত্ববাদীরা বেশ অনকেদিন ধরেই গৌড়ের প্রাচীন রাজা শশাঙ্ককে তুলে ধরতে চেষ্টা করছেন, যার রাজধানী ছিল এখনকার মালদা শহরের কাছে কর্ণসুবর্ণতে।
ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ দিকে শশাঙ্ক ছিলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে একজন সামন্ত রাজা। তবে পরে তিনি স্বাধীন ও সার্বভৌম গৌড়ভূমির শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
রাজা শশাঙ্ক মারা গিয়েছিলেন ৬৩৭ বা ৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ। এর মোটামুটি ৪৫ বছর আগে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন এবং তখন থেকেই (৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ) বঙ্গাব্দ চালু করা হয় – এটা ধরে নিলে ওই তত্ত্বটা অনেকটা মিলে যায়।
কারণ বঙ্গাব্দর সঙ্গে খ্রিস্টীয় অব্দের ব্যবধানও ঠিক ৫৯৩ বছরের। এই মুহুর্তে যেমন ১৪২৯ বাংলা সাল শুরু হচ্ছে, আর সেটা ইংরেজি বা খ্রিস্টীয় ২০২২ সাল – ফলে গণনার ব্যবধানটা ৫৯৩ বছরের।
পান্তা ভাত যেভাবে জয় করেছিল ইংরেজ শাসকদের হৃদয়
তবে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও গবেষক অমর্ত্য সেন তাঁর একাধিক নিবন্ধ, বক্তৃতা ও গ্রন্থে মুঘল সম্রাট আকবরকেই বঙ্গাব্দ’র প্রবর্তক হিসেবে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন।
ষাটের দশকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা বর্ষপঞ্জী সংস্কারের জন্য ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্-কে সভাপতি করে সরকার যে কমিটি গঠন করেছিল, তাদেরও স্পষ্ট রায় ছিল সম্রাট আকবর খ্রিস্টীয় ১৫৮৫ সালে বঙ্গাব্দের সূচনা করেন।
বঙ্গীয় সনাতনী সংস্কৃতি পরিষদের সম্পাদক প্রবীর ভট্টাচার্য অবশ্য মনে করেন, “ভারতে যে অসংখ্য ইতিহাস বিকৃতির ঘটনা ঘটানো হয়েছে, আকবরের হাতে বঙ্গাব্দর সূচনাও সেরকমই একটা!”
“বঙ্গাব্দ বাঙালির নিজেদের হাতে তৈরি একটা জিনিস, কিন্তু এটার কৃতিত্বও কেউ কেউ মুঘলদের দিতে ভালবাসেন। কিন্তু সেটা আসলে ঐতিহাসিকভাবে অসত্য”, বলছিলেন মি. ভট্টাচার্য।
বাংলার একজন হিন্দু রাজাকে তার ‘প্রাপ্য গৌরব’ ফিরিয়ে দিতেই পরিষদ পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এই প্রচারাভিযান চালাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন তিনি।
ইতিহাস কী বলছে?
কিন্তু বঙ্গাব্দ’র সূচনা নিয়ে ইতিহাসবিদরা কী বলছেন?
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক ইসলামের বিশেষজ্ঞ কিংশুক চ্যাটার্জির পরিষ্কার জবাব, “শশাঙ্কর আমলে তো বাংলা ভাষাটাই চালু হয়নি। কাজেই তিনি বাংলার জন্য আলাদা অব্দ বা সাল চালু করেছিলেন এটা ভাবাটা বেশ বাড়াবাড়ি।”
“বরং ইতিহাসে আমাদের বলে, মুঘল বাদশাহ আকবর বাংলা জয় করার পর এখানে একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিলেন।
“তারা যখন দেখলেন বাংলা থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য একটা ক্যালেন্ডার দরকার, আর সেটাকে হিন্দু শকাব্দর সঙ্গে সংযুক্ত না করে বরং মুসলিম হিজরীর সঙ্গে কানেক্ট করেই ক্যালিব্রেট করা যাক।
“খুব সম্ভবত সেভাবেই আকবরের দূতরা বঙ্গাব্দ চালু করে গিয়েছিলেন”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন কিংশুক চ্যাটার্জি।
বাংলায় মুঘল যুগের ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ, প্রবীণ ইতিহাসবিদ অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য এক্ষেত্রে একটু ভিন্নমত পোষণ করেন।
বাঙালি নারীদের মধ্যে টিপ পরার প্রচলন শুরু হলো যেভাবে
বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, “আসলে ফসল তোলার ভিত্তিতে সাল গোনার যে রেওয়াজ, যাকে ‘ফসলি’ বলা হয়, সেটা কিন্তু ভারতের প্রায় সর্বত্রই চালু ছিল, বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়।”
“এই ফসলী-কেই আকবর বাংলায় একটু অদল-বদল করে হয়তো ‘রেগুলারাইজ’ করেছিলেন – সেই কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে তার। কিন্তু বঙ্গাব্দর প্রবর্তক আকবর, এটা বলা কতটা সমীচীন হবে আমি ঠিক নিশ্চিত নই।
“আসলে সাল গণনার ইতিহাস একটা জিনিস, তার বাস্তবায়ন অন্য জিনিস। আকবরের আমলের বহু আগে থেকেই বাংলা সাল গুনতো নিজের মতো করে, তখন হয়তো পদ্ধতিটা বদলেছে”, বলছিলেন অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
অমর্ত্য সেনের বক্তব্য
সম্রাট আকবরকে বাংলা ‘সন’ বা বঙ্গাব্দর উদ্ভাবক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অবশ্য কোনও দ্বিধাই নেই অমর্ত্য সেনের। ‘দ্য আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’ বইতেও সে কথা পরিষ্কার লিখেছেনও তিনি।
বছর তিনেক আগে কলকাতার ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে একটি স্মারক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, “বাংলা ‘সনে’র একটি বিশেষত্ব হল – আকবর সারা ভারত জুড়ে বহু-ধর্মে গ্রাহ্য যে ক্যালেন্ডার ‘তারিখ-ইলাহী’ চালু করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন, সেটার প্রভাব কিন্তু আজও টিঁকে আছে শুধু এই বঙ্গাব্দেই।”
ওই বক্তৃতায় তিনি আরও বলেন, “আকবরের আমলে যখন মুসলিম ক্যালেন্ডার বা হিজরীর প্রথম সহস্রাব্দ শেষ হয়ে আসছে – তিনি তার রাজত্বে একটি বহু-সংস্কৃতির ক্যালেন্ডার চালু করার প্রয়োজন অনুভব করেন। এটাই ছিল তারিখ-ইলাহী।
দক্ষিণ ভারতের কর্নাটক কি হিন্দুত্ববাদের নতুন পরীক্ষাগার?
“এই ক্যালেন্ডার হিন্দু সূর্যসিদ্ধান্ত রীতি অনুসরণ করত, আবার মুসলিম হিজরীর বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যও এতে সংযোজিত হয়েছিল – যেমন হিজরীর চান্দ্র ইতিহাস।”
মজার ব্যাপার হল, আকবরের দরবার ছিল যেখানে সেই দিল্লি-আগ্রাতেও কিন্তু তারিখ-ইলাহী গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। অথচ সেই ক্যালেন্ডারের একটি ‘অফশুট’ (শাখা) পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে আজও সগৌরবে টিঁকে আছে – যার নাম বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন।
তবে অনেক গবেষকই অমর্ত্য সেনের এই বক্তব্য মানেন না।
আকবর বা শশাঙ্ক ছাড়াও তৃতীয় একটি মতবাদ বলে, তিব্বতের বিখ্যাত শাসক স্রং সন গাম্পোর পিতা স্রং সন এক সময় পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা জয় করেছিলেন – আর সে সময় তার ছেলের জন্ম হলে সেই মুহুর্তটিকে স্মরণীয় করে রাখতেই তিনি ওই অঞ্চলে ‘সন’ গণনা চালু করেছিলেন।
এই তিনটি মতবাদের তুল্যমূল্য বিচার করে গবেষক ও অধ্যাপক তমাল দাশগুপ্ত একটি নিবন্ধে বলেছেন – বঙ্গাব্দর প্রবর্তক হিসেবে শশাঙ্কর দাবিই সবচেয়ে জোরালো, আর আকবরের দাবিই সবচেয়ে দুর্বল।
শশাঙ্কর দাবির সমর্থনে তিনি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে শৈব শাসক শশাঙ্কর আমল থেকে আজ পর্যন্ত একটি ধর্মীয় উৎসব (শিব-চন্ডীর মেলা) আজও চলে আসছে।
তমাল দাশগুপ্তর প্রশ্ন, “শশাঙ্ক প্রবর্তিত একটি শৈব-তান্ত্রিক উৎসব যদি বাংলার বুকে একটানা চোদ্দোশো বছর ধরে চলতে পারে, তাহলে তার প্রবর্তিত অব্দ কি পারে না?”
হিন্দু রাজা শশাঙ্কর সমর্থনে এই ধরনের নানা যুক্তিকে আশ্রয় করেই সঙ্ঘ পরিবার এখন তাকে বঙ্গাব্দর প্রবর্তক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে – যে উদ্যোগের অবশ্যই একটি রাজনৈতিক মাত্রাও আছে।