২০১৫ সালে ‘ডন’ পত্রিকায় আমার একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়- ‘পাকিস্তানের ডোনাল্ড ট্রাম্প’ শিরোনামে। নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার ১৬ মাস আগে এবং ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রায় তিন বছর আগে। দুই দিক থেকেই নিবন্ধটি অনেক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। এর কিছুদিন পর ওয়াশিংটনভিত্তিক বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান তার নিবন্ধিত ডন-এ প্রকাশিত এক প্রতিক্রিয়ায় আমার তুলনাকে ‘নিছকই অতিমাত্রা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তার নিবন্ধের উপসংহার টেনেছিলেন এই বলে, ‘নয়া পাকিস্তান নির্বোধ হতে পারে, কিন্তু কদর্য বা ঘৃণ্য নয়।
রাজনীতির জগতে সাত বছর একটি অনন্ত সময়। নয়া পাকিস্তান মানে কী? ২০১৫ সাল থেকে এই পর্যন্ত অনেক কিছুই ঘটেছে- ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি পদে জয়ী হন, কিন্তু পুনরায় নির্বাচনে ব্যর্থ হন। তারপর থেকে তিনি এখনও পর্যন্ত ক্ষমতায় ফেরার চেষ্টা করেই যাচ্ছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে খান বিজয়ী হয়েছিলেন এবং নয়া পাকিস্তান বিক্রি করার জন্য প্রায় চার বছর সময় পেয়েছেন। তার ভাগ্য বর্তমানে সংসদে অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর নির্ভর করছে।
ট্রাম্প-খান তুলনা পুনরায় করা সময়োপযোগী। কিছু মিল অবশ্যই অপরিবর্তিত যা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। তারপর, এখনকার মতো উভয়ের রাজনৈতিক ঝুলিতে সমর্থক জনতাকে গুলি চালানোর জন্য প্রচুর অশ্লীল ভাষার ব্যবহার রয়েছে। তাই এমন এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে যা অপূর্ণ হলেও তাদের অনুসারীদের কল্পনায় পৌঁছে দিতে সাহায্য করছে।
প্রথমদিকে এই উপাদানগুলো রাজনীতির নাটকে খুব ভালো কাজ করেছিল। একবার ক্ষমতায় বসার পর, ‘কমলা চামড়া’র এই রাষ্ট্রপতি তার রাষ্ট্রে সুবিধাবাদী, সাপের তেল বিক্রেতা এবং সাদা চামড়ার চরমপন্থীদের চাষবাস করেছিলেন। মিথ্যা তথ্যের ঝড়ের মধ্যে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেই শাসনে ব্যর্থতা ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী করা হয়েছিল। ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্য অনুসারে, ট্রাম্পের মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর দাবি চার বছরে মোট ৩০,৫৭৩টি! চিত্তাকর্ষক বটে!
কিন্তু আমেরিকানরা খুব দ্রুতই বুঝতে পেরেছিল, ট্রাম্প ক্যামেরার সামনে যতটা উজ্জ্বল, শাসনের দক্ষতায় তিনি ততটাই অজ্ঞাত। অর্থনীতি, জাতিগত বিষয় এবং বৈদেশিক সম্পর্ক সব দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। পুতিন-ট্রাম্প ব্যক্তিগত সম্পর্ক শক্তিশালী হওয়ার সাথে সাথে ইউরোপীয় মিত্রদের সাথে সম্পর্ক হ্রাস পেয়েছে। ভোটাররা যখন দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য ট্রাম্পকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, তখন বিষয়টি ওই ব্যক্তির কাছে দুর্বোধ্য ছিল, যে কিনা নিজের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
নির্বাচনের ফলাফল পাল্টানোর জন্য তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার জন্য আমেরিকার গণতন্ত্র খুবই শক্তিশালী প্রমানিত হয়েছিল। বিচার বিভাগ এবং সামরিকবাহিনী তার ভোটিং মেশিন বাজেয়াপ্ত করার এবং পুনরায় নির্বাচন করার প্রস্তাবকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে। ক্যাপিটেল হিলের অবরোধ- ২০০ বছরের গণতন্ত্রের দেশে বিশ্বকে হতবাক করেছিল।
যদিও স্থান, সময় এবং মানুষ পাকিস্তানের জন্য স্পষ্টতই আলাদা, কিন্তু বেশ কিছু মিল আশ্চর্যজনকভাবে কাছাকাছি এবং ঘনিষ্ঠ। খান ইতিমধ্যেই তার ক্ষমতাচুত্যির জন্য একটি ব্যাখ্যা তৈরি করেছেন- তিনি তার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি এবং ইসলামাতঙ্কের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য পশ্চিমাদের দ্বারা শাস্তি পাচ্ছেন।
২৭ মার্চ – ইসলামাবাদের ডি-চক এ – পাকিস্তানের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে বড় সমাবেশ’ করার জন্য দল এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে সংঘবদ্ধ করছে পিটিআই। তাদের লক্ষ্য একটাই- পিটিআই এবং বিরোধীদল উভয় সংসদ সদস্যদের এই বার্তা দেওয়া যে, তারা যেন অনাস্থা প্রস্তাবে ভোট দিতে সংসদে প্রবেশ না করে।
একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য ডি-চক থেকে ক্যাপিটল হিলকে আলাদা করে। যেখানে ট্রাম্প তার সমর্থকদের চোখের ইশারায় ও মাথা নাড়িয়ে বের করে এনেছেন, সেখানে কল্পনার আর কিছুই বাকি রাখা হয়নি। তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী বলেছেন, সেদিন ভোট দিতে আগত সমস্ত সংসদ সদস্যকে জাতীয় পরিষদে দশ লাখ ‘খান’ সমর্থকের মধ্য দিয়ে যেতে হবে এবং ফিরতেও হবে সেই পথ দিয়ে। সেখানে তারা মারমুখী জনতার মুখোমুখি হবে।
ডি-ডের দিনটি কতটা সহিংস হয়ে ওঠে বা চূড়ান্ত ফলাফল কী হতে পারে তা এখনই জানা সম্ভব নয়। ক্যাপিটল হিল অবরোধ আমেরিকার গণতন্ত্রকে একটি সুতোয় ঝুলিয়ে রেখেছিল। তা সত্ত্বেও এই প্রক্রিয়াটি গণতন্ত্র প্রক্রিয়াকে নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। পাকিস্তানের সামনে যা আছে তা খানের ক্ষমতাচ্যুতির মাধ্যমে শেষ হতেও পারে বা নাও হতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি চলে গেলে তার উত্তরাধিকার কী হবে?
গণতন্ত্র: সংসদ সদস্যদের তাদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা গণতন্ত্র ও শালীনতার মুখে চপেটাঘাত। এটা যে সংবিধান লঙ্ঘন তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। কিন্তু, সত্যি কথা বলতে, এর আগে আরও খারাপ ঘটনা ঘটেছে । চারটি সামরিক আইন তাদের বুটের তলায় সংবিধানকে পদদলিত করেছে। এমনকি প্রকাশ্যে সংবিধান লঙ্ঘন না করেও, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ এবং জেনারেলরা কয়েক দশক ধরে তাদের পকেট ভর্তি করেছেন এবং তাদের সম্পদসমূহ নাগালের অযোগ্য স্থানে সংরক্ষণ করে রেখেছেন।
অর্থনীতি: আজকের গতিশীল মুদ্রাস্ফীতি, বারবার আইএমএফের কাছে ধর্না দেওয়া, কালো টাকাকে আরও সাদা করা, রুপির নাটকীয় পতন এবং ভারত ও বাংলাদেশের তুলনায় কর্মদক্ষতায় আরও নিচে নেমে যাওয়া – এগুলো সবই উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক দিক। তবে একা পিটিআইকে দোষারোপ করবেন না। পাকিস্তানের পদ্ধতিগত অর্থনৈতিক দুর্বলতাগুলো মূলত- প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর অতিরিক্ত ব্যয়, জাতীয় সম্পদের নির্বিচার লুণ্ঠন এবং আশাহীনভাবে কম দক্ষ কর্মীবাহিনী থেকে উদ্ভূত। এ কারণেই সিপিইসির নতুন গঠনতন্ত্রে ক্ষুদ্র শিল্পায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। পিএমএলএন আমলেও পিপিপি সরকারেও একই ঘটনা ঘটত।
বৈদেশিক সম্পর্ক: বিশ্ব লক্ষ্য করেছে- প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ওসামা বিন লাদেনকে একজন শহীদ বলে প্রসংশা করা, তালেবানদের মুক্তিদাতা বলা, ইউক্রেন যুদ্ধের ঠিক আগে আগে পুতিনের সাথে করমর্দন, ইইউকে অযৌক্তিক থুথু দেওয়া- যদিও এটি পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সহায়তা নেওয়ার একটি অংশ এবং সৌদি আরবের সাথে সম্পর্কের অবনতি। তবুও সবকিছুই এখনও বিপরীতমুখী হতে পারে। একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী সবকিছুই ঠিক করে দিতে পারেন।
শিক্ষা: সম্ভবত খানের বিষাক্ত উত্তরাধিকার প্রায় অপরিবর্তনীয়ই হবে। মাদ্রাসাগুলো আজকে ঠিক তাই করে যা তারা কয়েক দশক এবং শতাব্দি ধরে করে আসছে। পাঞ্জাবে স্কুলগুলো এখন মাদ্রাসা হিসেবে বেশি এবং স্কুল হিসেবে কম কাজ করে। এমনকি সমাজের অতি ধনীরাও অনেকটা অব্যাহতিপ্রাপ্ত। তথাকথিত জাতীয় পাঠ্যক্রম মিশ্র, বিভ্রান্ত এবং অজ্ঞ প্রজন্ম তৈরি করবে যা রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত ভয়ংকর। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে খান হায়ার এডুকেশন কমিশন (এইচইসি) ভেঙে দিয়েছেন এবং এটিকে যড়যন্ত্রের কেন্দ্রে পরিণত করেছেন।
খান যখন ঘোষণা করেছিলেন, নয়া পাকিস্তান হবে রিয়াসাত-ই-মদিনা, তখন বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ ভেবেছিল এটি একটি পরিচ্ছন্ন ও ন্যায়সঙ্গত পাকিস্তানের রূপক। ওয়াশিংটনে আমাদের বন্ধুকে ক্ষমা করা যেতে পারে, পাকিস্তানকে ‘না এটি কদর্য বা ঘৃণ্য’ হিসেবে ভাবার জন্য। প্রায় সবাই একটি লুকানো বার্তা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, কোনো ধর্মীয় রাষ্ট্রের প্রধানকে কোনো না কোনোভাবে ঐশ্বরিক অনুমোদন দাবি করতে হবে। নৈতিক আচরণ এবং সঠিক পোশাক সম্পর্কে প্রায় প্রতিদিনের জ্বলন্ত পরামর্শসহ খানের ‘উচ্চ দৃষ্টি’ আমাদের সামনেই রয়েছে। এবং আপনি যদি নিশ্চিত না হোন যে, নয়া পাকিস্তানের মাথা থাকবে নাকি চলে যাবে, তবে অনুগ্রহ করে মনে রাখবেন, ‘শুধুমাত্র প্রাণীরা নিরপেক্ষ হতে পারে।’
সূএ: somoy tv