‘রাঙামাটির রঙে চোখ জুড়ালো, সাম্পান মাঝির গানে মন ভরালো’ গানের মতো রূপের রানি রাঙামাটির মায়ায় পড়ে যান দেশ-বিদেশের পর্যটকরা। সবুজ পাহাড়ের ওপর সাদা মেঘের ভেলা এবং স্থির জলরাশির কাপ্তাই হ্রদ নজর কাড়ে পাহাড়প্রেমীদের। সুযোগ পেলে যান্ত্রিক জীবন ছেড়ে নিরিবিলি প্রকৃতিকে উপভোগ করতে একবার সাদা জলের ঝরনায় গা ভেজাতে আসেন ভ্রমণপিপাসুরা। করোনায় পাহাড়ে পর্যটক আসা বন্ধ থাকলেও দুঃসময় কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে পর্যটন খাত। তবে ঈদের পর ছুটির দিনগুলোয় পর্যটক বাড়লেও তা আগের তুলনায় কম বলে জানান পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, প্রতিটি দেশে রাঙামাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণ রয়েছে। বছর দশেক আগে দেশের বাইরে থেকে অনেক পর্যটক ঘুরতে আসতেন। রাঙামাটিতে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের আট-দশ হাজারের বেশি পর্যটকের পা পড়ত। কিন্তু এখন বিদেশি পর্যটক নেই বললেই চলে। বিদেশিদের আকৃষ্ট করার মতো বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকায় তাদের চাহিদা কমছে বলে জানা যায়। তবে পর্যটন মহাপরিকল্পানায় রাঙামাটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন জায়গা হিসেবে প্রথম পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত থাকবে বলে বাংলাদেশ টুরিজম বোর্ড জানিয়েছেন। জানা গেছে, পাহাড়ের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে পর্যটকদের আকৃষ্ট করা, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পর্যটন মেলার আয়োজন করা এবং রাতের বিনোদনের (প্রতিদিন সংগীত অনুষ্ঠান, নৃত্য, কবিতা এবং স্থানীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য প্রদর্শনী) ব্যবস্থা করলে পর্যটন খাত আরও এগিয়ে যাবে।সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, রাঙামাটি শহরে ৫৫টি হোটেল-মোটেল রয়েছে। বছর পাঁচেক আগেও পর্যটনে ভরপুর ছিল রাঙামাটি। সব হোটেল-মোটেল বুকিং হয়ে যেত। কিন্তু পর্যটক কমার কারণে হোটেল-মোটেলগুলো ফাঁকা রয়ে যায়। বর্তমানে পর্যটন কেন্দ্রগুলোয় বাইরের পর্যটকের চেয়ে স্থানীয় দর্শনার্থীদের সংখ্যা বেশি। তবে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে আশাবাদী তারা। অন্যদিকে সাজেকে আগের চেয়ে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে রাঙামাটি আবাসিক হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সভাপতি মো. মঈন উদ্দিন সেলিম বলেন, যেভাবে আধুনিক হোটেল হচ্ছে, তার তুলনায় বর্তমানে পর্যটক অনেক কম। বান্দরবান-খাগড়াছড়িতে পর্যটককে আকৃষ্ট করার জন্য নতুন নতুন পর্যটন স্পষ্ট হলেও রাঙামাটিতে হচ্ছে না। রাঙামাটির পর্যটন খাত নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা না করার কারণে পর্যটন কমছে। স্থানীয় নুরুল আলম ও জাহাঙ্গীর বলেন, বেসরকারিভাবে বিনিয়োগ করে কৃত্রিমভাবে আরও পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করা গেলে এখানকার পর্যটক বাড়বে। স্থানীয়দের পর্যটন খাতের সংশ্লিষ্ট করতে হবে এবং ট্যুর গাইডের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তাহলে এ খাতটি এগিয়ে যাবে। পর্যটন টুরিস্ট বোট মালিক সমিতির সদস্য আলাউদ্দীন টুটুল বলেন, এখন পর্যটকের মৌসুম না হওয়ায় পর্যটক কম। তাছাড়া বিভিন্ন একাডেমিক পরীক্ষার কারণে অনেকে ব্যস্ত আছেন। পরীক্ষা শেষ হলে পর্যটন খাতে সুদিন আসবে বলে তিনি মনে করেন। রাইন্ন্যা টুগুন ইকো রিসোর্ট ব্যবস্থাপনা পরিচালক ললিত চাকমা বলেন, বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে, যার কারণে পর্যটন খাতে এটার প্রভাব পড়েছে। সরকারি-বেসরকারিভাবে পর্যটকের জন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। বিদেশি পর্যটকের বিষয়ে তিনি বলেন, ভ্রমণের চাহিদায় অন্যান্য জায়গার চেয়ে পার্বত্য অঞ্চল এগিয়ে। অনেক জায়গায় বর্ষাকালে যাওয়া যায় না, আবহাওয়ার বিরূপ পরিবেশ থাকে। আবার অনেক জায়গায় নির্দিষ্ট সময় পর পর্যটকের আকর্ষণ থাকে না। কিন্তু পাহাড়ে সারাবছর আকর্ষণ থাকেÑশীতকালে যেমন, বর্ষাকালেও তেমন। তাদের আসাটা সহজ করতে হবে। প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ট্যুর গাইড বাড়াতে হবে। তাহলে অন্যান্য এলাকা মতো এখানে বিদেশি পর্যটকের পাশাপাশি দেশি পর্যটকের সংখ্যাও বাড়বে। রাঙামাটি পর্যটন করপোরেশনের ম্যানেজার সৃজন বিকাশ বড়ুয়া জানান, পর্যটন একটি বাণিজ্যিক বিষয় হওয়ায় এর সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত। সরকার বর্তমানে ভ্রমণব্যয় সীমিত করছে এবং বিভিন্ন একাডেমির পরীক্ষা চলার কারণে এর প্রভাব রাঙামাটিতেও পড়েছে। তাই ছুটির দিনে তেমন পর্যটক আসছে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ টুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের জানান, পর্যটন মহাপরিকল্পনায় রাঙামাটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ে থাকবে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে উন্নত দেশের মতো পাহাড়ের চূড়ায় সরকারের দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা বা কেব্ল কার তৈরির পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে মাস্টার প্ল্যান পরিপূর্ণ হলে তা বলা যাবে বলে তিনি জানান। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিদেশি পর্যটকনির্ভর করছে এখানকার সুযোগ-সুবিধা, চলাচল ও নিরাপত্তার এবং উদ্যোক্তাদের ওপর। কারণ ঘুরে যাওয়ার পর তারা খারাপ কোনো মন্তব্য করলে তার প্রভাব পর্যটন খাতের ওপর পড়ে।