একদিকে ডিজেল, সার-কীটনাশক ও শ্রমিকের মূল্য বেশি; অন্যদিকে প্রকৃতির বৈরী আচরণ। সবমিলিয়ে শীতের সবজি চাষ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন যশোরের চাষিরা। এ অবস্থায় দুশ্চিন্তার পড়েছেন তারা। শেষ সময়ে সবজি চাষের পরিচর্যায় তারা ব্যস্ত সময় পার করলেও সবজি উৎপাদনের উপযুক্ত সময়ে দাম নিয়ে শঙ্কায় আছেন তারা। এ অবস্থায় প্রান্তিক চাষিরা সরকারি সহায়তার দাবি জানিয়েছেন। দেশের সবজি উৎপাদনের উল্লেখযোগ্য জেলার মধ্যে যশোর হচ্ছে অন্যতম জেলা। দেশের মোট চাহিদার ৬০ শতাংশ সবজিই এ জেলা থেকে সরবরাহ করা হয়। প্রায় বছরজুড়েই জেলার বিভিন্ন উপজেলার বিস্তীর্ণ মাঠে নানা জাতের সবজি চাষ হয়। তবে শীত মৌসুমকে টার্গেট করে এ জেলার চাষিরা প্রচুর সবজি চাষ করলেও এবছর প্রকৃতির বৈরী আবহাওয়ার কারণে তারা অনেক পিছিয়ে পড়েছেন। অন্যান্য বছরে এ সময় বাজারগুলো আগাম জাতের শীতকালীন সবজিতে সয়লাব হয়ে গেলেও দীর্ঘ অনাবৃষ্টি ও খরার কারণে উৎপাদনের সময় প্রায় এক মাস পিছিয়ে গেছে বলে জানান চাষিরা। সর্বশেষ বৃষ্টি পেয়ে সবজি চাষ শুরু করলেও চাষিরা খরচ মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। চাষিরা জানান, একদিকে প্রকৃতির বৈরিতার কারণে তারা চাষে কোনো লাভ করতে পারছেন না। এরপর সার-কীটনাশকের সংকট ও মূল্য বেশি। একইসঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত শ্রমিকের মূল্য মেটাতে গিয়ে তারা পথে বসতে চলেছেন। এ অবস্থায় সবজির ন্যায্য দাম ও সরকারি সহায়তার দাবি তাদের। সরেজমিনে যশোর সদরের নোঙরপুর মাঠে গিয়ে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ ক্ষেতে কৃষকরা তাদের সবজির পরিচর্যায় ব্যস্ত রয়েছেন। এ সময় তারা চলতি মৌসুমের সবজি চাষ নিয়ে নানা আক্ষেপ ও উদ্বেগের কথা জানান। কথা হয় নোঙরপুর গ্রামের সবজিচাষি আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, তাদের এলাকায় প্রায় বছরজুড়েই কপি ও করোলার চাষ বেশি হয়। এ বছর তিনি তিন বিঘা জমিতে বাঁধাকপি ও ফুলকপির চাষ করেছেন। এরই মধ্যে টপিক্যাল কুইক, সামারগ্রিন ও টাচি বল নামে বাঁধাকপি এবং সিনজ ও হোয়াইট সোনা নামে ফুলকপি রয়েছে। তিনি বলেন, অন্যান্য বছরে ঠিক এই সময়ে এসব সবজি আমরা বাজারে তুলতে পারলেও এ বছর দীর্ঘ অনাবৃষ্টি ও খরার কারণে প্রায় এক মাস পিছিয়ে রয়েছি। ফলে সময়মতো এ বছর শীতের এ সবজি বাজারে তুলতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন বলে জানান সবজিচাষি আনোয়ার হোসেন। একই মাঠে কথা হয়, চাষি রিপন হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এবার সবজি চাষে তাদের প্রচুর খরচ বেড়েছে। এর বড় কারণ হচ্ছে ডিজেল সার, সার-কীটনাশকের দাম বৃদ্ধি ও সংকট। বিশেষ করে সারের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে, যে কারণে উচ্চমূল্যে সার-কীটনাশক কিনে জমিতে প্রয়োগ করতে গিয়ে আমরা পেরে উঠছি না। তিনি বলেন, বিগত দুই বছরে আমরা সবজি চাষে লাভ করতে পারিনি। এ বছর এই মাঠের শত শত বিঘার করোলায় পোকা লেগে নষ্ট হয়ে গেছে। এতে আমরা চরম লোকসানের শঙ্কায় আছি। গোলাম সরোয়ার নামে আরেক চাষি বলেন, বাঁধাকপি ও ফুলকপি চাষে বিঘাপ্রতি ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। অথচ এই কপি যখন আমরা বাজারে তুলব, তখন এর দাম পাওয়া যাবে না। এতে নিশ্চিত আমরা ক্ষতির মুখে পড়ব বলে মনে করছি। তিনি বলেন, বাজারে সার কিনতে গেলে সার পাওয়া যাচ্ছে না। গেলেও তা অতিরিক্ত দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। একই সঙ্গে শ্রমিকের মূল্যে আগের চেয়ে জনপ্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বেড়েছে। এ অবস্থায় আমরা পেরে উঠছি না। তিনি বলেন, সরকার যদি আমাদের প্রণোদনার আওতায় না আনে, তাহলে আগামীতে এ অঞ্চলে অনেক চাষিই ঝরে পড়বে। তারা বিকল্প হিসেবে অন্যকিছু চাষ করতে বাধ্য হবে। এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হক বলেন, আবহাওয়াজনিত সমস্যার কারণে এ বছর শীতকালীন সবজি চাষে কৃষক কিছুটা পিছিয়ে আছে বটে, তবে শেষ সময়ে বৃষ্টি পেয়ে তারা পুরোদমে চাষ শুরু করেছেন। আশা করছি, সামনে কোনো বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে কৃষক তাদের ক্ষেতে বাম্পার ফলন পাবেন। উৎপাদনের উপযুক্ত সময়ে তারা ভালো দামে সবজি বিক্রি করে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন বলে তিনি দাবি করেন। চলতি শীত মৌসুমে যশোরে ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজির আবাদ হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।