চাষাবাদ সহজ হওয়ায় এবং চাষে লাভবান হওয়ার ফলে লালমনিরহাটে বাড়ছে সুপারির চাষ। ছোট-বড়, শতবর্ষী হাজার হাজার সুপারি বাগান রয়েছে লালমনিরহাট জেলায়। এ জেলার মানুষের বিয়েশাদি, আত্মীয় আপ্যায়ন আর সামাজিকতায় পান-সুপারির প্রচলন ও কদর সবার ওপরে। নববধূর বাড়ি থেকে পান-সুপারি না গেলে অনর্থ কাণ্ড হতে পারে! তাই পান আর সুপারি থাকতেই হবে। এমন বাড়ি পাওয়া যায় না, যে বাড়িতে দু-চারটি সুপারি গাছ নেই! কোনো কোনো বাগানের সুপারি গাছের সঙ্গে আবাদ করা হয় হরেক জাতের গাছপান। দু-একজন আধুনিক শিক্ষিত কৃষক সুপারির সঙ্গে করেছেন লটকনের চাষ, যাতে চতুর্মুখী লাভ হয়। বছরে শতকোটি টাকার সুপারি বিক্রি হওয়ায় স্থানীয় চাষিরা এটিকে চা বা পাটের মতো অর্থকরী ফসল হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য দাবি করছেন। জানা যায়, স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে জেলার সুপারি যাচ্ছে গাইবান্ধা, বগুড়া, ঢাকা, কুমিল্লাসহ কয়েকটি বড় শহরে। আকার বড় ও দামে সস্তা। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সুপারির মৌসুমের সঙ্গে মিল নেই, তাই চাহিদাও প্রচুর। এত কিছুর মাঝেও অর্থকরী ফসলের তকমা জোটেনি সুপারির ভাগ্যে। পাট, তামাক, কিংবা চা, এগুলোর কোনো কিছুর মতো অর্থকরী ফসলের খাতায় নাম নেই। অথচ নীরবে-নিভৃতে বাড়ির উঠান আর ঝোপঝাড়ে থেকেও বছর বছর অর্থের জোগান দিচ্ছে গৃহস্তকে ও চাষিকে। বেলাল নামের তরুণ সুপারিচাষি বলেন, আমাদের বাবা-দাদার হাতে গড়া সুপারির বাগান আছে। সুপারির বাগানে কোনো রকম পরিচর্যা করতে হয় না। নতুন করে আমরা সুপারি বাগান করেছি। সুপারির নতুন ও পুরোনো বাগানে কলার চাষ করেছি। কলা খুব একটা খারাপ হচ্ছে না।তারিকুল রানা জানান, এবার ২০টি সুপারির গাছ থেকে ৩০ হাজার টাকার সুপারি বেচেছেন। এখনও গাছে সুপারি কিছু আছে। কৃষি অধিদপ্তর বলছে, এ বছর জেলার পাঁচ উপজেলায় ৫১২ হেক্টর জমিতে সুপারি চাষ হয়েছে। ভালো ফলন হওয়ায় ১৪ হাজার ৩৩৬ মেট্রিক টন সুপারির ফলন ছাড়িয়ে যাবে। হেক্টরপ্রতি প্রায় ২৭ টন সুপারির ফলন হবে, যার বাজারমূল্য প্রায় ১২ কোটি টাকা। এদিকে জেলার দুড়াকুটি, শিয়ালখোয়া, কাকিনা, চাপারহাট, চামটাহাট, ভুল্লারহাট, ভোটমারি, বড়বাড়ি, নয়ারহাট ও দইখাওয়া হাট মূলত সুপারির বড় হাট হিসেবে পরিচিত। চাপারহাটের ইজারাদার খোকন মিয়া ও বুড়িরহাটের ইজারাদার পিন্টু বসুনিয়া বলেন, আমরা প্রতি সিজনে ১৯ থেকে ২০টা সুাপারির হাট পাই। ২০০ থেকে ৪০০ টাকা পোন হিসেবে বিক্রি হয়। আটটি সুপারিতে এক পোন। সর্বোচ্চ সুপারি ওঠে চাপারহাট, চামটা, শিয়াল খোয়া ও কাকিনায়। জেলার প্রতি হাটে তিন হাজার পোন পর্যন্ত সুপারি ওঠে। সিজন শেষে হিসাব করলে ৫০ কোটির বেশি সুপারি কেনা-বেচা হয়। বেশ কিছু সুপারিচাষির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলায় মোট উৎপাদিত সুপারি শতকোটি টাকার বেশি। কারণ অনেক গৃহস্থই সিজনে সুপারি বেচেন না। তারা মাটির নিচে পলিথিন বা বস্তাবন্দি করে জাগ দিয়ে রাখেন। সেই সুপারি অফ সিজনে বিক্রি করেন। তাতে ভালো দাম পাওয়া যায়। সুপারির ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম বলেন, তার মতো ব্যবসায়ী ৩০ জনের বেশি আছে, যারা শুধু সুপারির ব্যবসা করেন। অফ সিজনে একেক জন ১৫০ থেকে তিন হাজার বস্তা সুপারি বাইরের জেলা থেকে নিয়ে আসেন। এসব তারা সুপারি টেকনাফ আর নোয়াখালী অঞ্চল থেকে নিয়ে আসেন, যার বাজারমূল্য ৪০ কোটি টাকার ওপরে। এখন ঢাকা ও কুমিল্লায় পাঠাচ্ছেন। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে অন্য জেলায় বছরে ১০০ কোটি টাকার বেশি সুপারি বিক্রি করা হয়। কৃষিবিদ সুশান্ত রায় বলেন, সামান্য ক্ষারীয় মাটিতে সুপারির ভালো ফলন হয়। আমাদের অঞ্চলে গাছ থেকে গাছের দূরত্ব সঠিক পরিমাপ করে লাগানো হয় না। সার বা গাছের খাদ্য দেয়া হয় না। সার ব্যবস্থাপনাসহ গাছ সঠিক দূরত্বে লাগালে অন্যান্য জেলা থেকে আমাদের উৎপাদন ভালো হবে। এতে কৃষকের লাভ বা ফলন কনটিনিউ হবে। জেলা কৃষি দপ্তরের উপপরিচালক হামিদুর রহমান বলেন, সুপারি বাগানের সঙ্গে চুই, গাছপান ও লটকনের মতো ফসলগুলো সাথী ফসল হিসাবে চাষের পরামর্শ দেব। চুই একটি দারুণ অর্থকরী ফসল। এটা খুব সহজেই সুপারির সঙ্গে চাষ করা যায়। এতে কৃষক প্রচুর লাভবান হবে।