পবিত্র ঈদুল ফিতর শুরুর মধ্য দিয়ে বিদায় নিয়েছে রহমত, বরকত ও নাজাতের মাস পবিত্র রমজান। এখন মহাবরকতের বারতা নিয়ে চলছে পবিত্র শাওয়াল মাস। রমজানে মাসব্যাপী যারা সিয়াম সাধনা করেছেন তাদের জন্য এ মাসে শুভ সংবাদ রয়েছে। আর তা হলো শাওয়াল মাসের ৬ রোজা। হজরত আবু আইউব আনসারী (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে রোজা রাখল এবং এ রোজার পর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখল সে যেন গোটা বছর রোজা রাখল’ (মুসলিম)। হাদিসে উল্লেখিত ছুম্মা অর্থ অতঃপর, ক্রমধারা বা ধারাবাহিকতার অর্থে ব্যবহৃত হয়। এদিক থেকে হাদিসটি প্রমাণ করে যে, আগে রমজানের রোজা পূর্ণ করতে হবে। যার ওপর রমজানের রোজা কাজা আছে সে আগে তার কাজা করবে তারপর শাওয়ালের রোজায় ব্রতী হবে। কারণ রাসূল (সা.) বলেছেন, যে রমজানের রোজা রাখবে অর্থাৎ পুরোপুরি। আর যার ওপর কাজা রয়ে গেছে সে তো রোজা পুরা করেছে বলে গণ্য হবে না যতক্ষণ ওই রোজাগুলোর কাজা আদায় না করে।
গুরুত্ব ও ফজিলত
আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ বান্দা তখনই লাভ করবে যখন সে নেক আমল করবে। আল্লাহর রহমত লাভের জন্য উসিলা আবশ্যক। তা হলো- নেক আমল। বান্দা যখন প্রকৃতভাবে স্রষ্টাকেই ভালোবাসে তখন তার জন্য কঠিন থেকে কঠিনতম আমলও সহজ হয়ে যায়। বান্দা যখন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের দিকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে অগ্রসর হয়, আল্লাহর অশেষ রহমত তার দিকে দৌড়িয়ে অগ্রসর হয়। বান্দা যখন আল্লাহর প্রেমে বিভোর হয়ে তাঁর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সামান্যতম আমল তাঁর দরবারে পেশ করে, আল্লাহ তখন বান্দার এই আমলকে ১০ থেকে ৭০ ও ৭০০ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেন। সুবহানআল্লাহ! হজরত উবাইদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি কি সারা বছর রোজা রাখতে পারব? তখন রাসূল (সা.) বললেন, তোমার ওপর তোমার পরিবারের হক রয়েছে, কাজেই তুমি সারা বছর রোজা না রেখে রমজানের রোজা রাখ এবং রমজানের পরবর্তী মাস শাওয়ালের ৬ রোজা রাখ, তাহলেই তুমি সারা বছর রোজা রাখার সওয়াব পাবে।’ (তিরমিযি)। মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি একটি নেক কাজ করে সে আল্লাহর অনুগ্রহে ১০টি নেকি পাবে। একটি ভালো কাজের প্রতিদান হিসেবে ১০ গুণ বৃদ্ধির ওয়াদা করা হয়েছে। কোনো স্থানে ৭০ গুণ, কোনো স্থানে ৭০০ গুণ আবার কোথাও সীমাহীন বলে (ওয়াল্লাহু উইদাআফু লিমাই ইয়াশাআ) বর্ণনা করা হয়েছে। এ জন্য বলা হয়, ১০, ৭০ ও ৭০০ দ্বারা আধিক্যতা বর্ণনা করা উদ্দেশ্য, নির্দিষ্ট সংখ্যা বর্ণনা করা উদ্দেশ্য নয়। রোজা মানুষের গুনাহমাফির মাধ্যমে বান্দাকে নিষ্কলুষ ও নির্ভেজাল করে। রোজার মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বান্দার গুনাহ মাফ করে দেন। একজন মানুষের জীবন সুন্দর ও স্বচ্ছভাবে যাপনের জন্য যে ধরনের গুণ-বৈশিষ্ট্যের প্রয়োজন, রোজা তা সৃষ্টি করে। ধর্মপ্রাণ মুসলমান ব্যক্তি যাতে শুধু মাহে রমজানের ফরজ রোজা রেখে থেমে না যান বরং তিনি কীভাবে সহজেই পূর্ণ বছরটা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার প্রিয় বান্দা ও ভালোবাসার পাত্র হয়ে থাকতে পারেন এবং কী করে চিরস্থায়ী জান্নাতের বাসিন্দা হতে পারেন এবং পরকালে তিনি কীভাবে সফলকাম থাকতে পারেন রাসূলুল্লাহ (সা.) উম্মতের সামনে এই পথ সুস্পষ্ট করে দিয়ে গেছেন। আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে মানব জাতিকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে একমাত্র তাঁরই ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। মহান সৃষ্টিকর্তা চান, বান্দা যেন সর্বদা ইবাদত-বন্দেগি করে। এমন অনেক পথই আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য খোলা রেখেছেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) উম্মতের সামনে তা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। অল্প নেক আমলের বিনিময়ে আল্লাহর অসীম দয়া ও অনুগ্রহের পাত্র হওয়ার জন্য নবী করিম (সা.) কর্তৃক বর্ণিত সহজ পন্থাসমূহ থেকে একটি অতি সহজ পন্থা হলো শাওয়াল মাসের ৬টি নফল রোজা। বান্দা যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এই রোজা রাখবে তখন আল্লাহ তাকে পূর্ণ একটি বছর রোজা রাখার সওয়াব দিয়ে দেবেন।
মহান আল্লাহ পাক হাদিছে কুদসিতে ইরশাদ করেন, ‘বান্দা-বান্দীরা নফল বা সুন্নত পালনের মাধ্যমে আমার নৈকট্য লাভ করে থাকে।’ পবিত্র শাওয়াল মাসে ৬টি রোজা খাছ সুন্নত বা মুস্তাহাবের অন্তর্ভুক্ত এবং বহু ফজিলতের কারণ। হজরত সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, রমজানের রোজা দশ মাসের রোজার সমতুল্য আর (শাওয়ালের) ৬ রোজা দু’মাসের রোজার সমান। সুতরাং এ হলো এক বছরের রোজা। শাওয়াল মাসে ৬টি রোজা রাখার এই আমলটা সহজ হলেও এর ফজিলত কতই না মহান। কারো পক্ষে সহজেই সম্ভব নয় এক বছর লাগাতার রোজা রাখা। অথচ এই আমলটা বিরাট ফজিলতসম্পন্ন ও সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব। আল্লামা ইবনে রজব (রহ.) বলেন, শাওয়াল মাসে রোজা রাখার তাৎপর্য অনেক। রমজানের পর রাখা রমজানের রোজা কবুল হওয়ার আলামত স্বরূপ। কেননা আল্লাহ তাআলা কোনো বান্দার আমল কবুল করলে, তাকে পরেও অনুরূপ আমল করার তৌফিক দিয়ে থাকেন। নেক আমল কবুলের আলামত ও প্রতিদান বিভিন্নরূপ। তার মধ্যে একটি হলো পুনরায় নেক আমল করার সৌভাগ্য অর্জন করা। তাই নামাজ, রোজা ও অন্যান্য ইবাদত বাকি এগার মাসেও চালু রাখা চাই। কেননা যিনি রমজানের রব, বাকি এগার মাসের রব তিনিই আল্লাহ। এ ছাড়া শাওয়ালের ৬ রোজা রাখার আরো ফায়দা হচ্ছে, কেয়ামতের দিন ফরজ আমলের কমতি নফল আমল দিয়ে পূরণ করা হবে। যেমন- রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন মানুষের আমলের মধ্যে সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব নেওয়া হবে। তিনি আরো বলেন, আমাদের রব ফেরেশতাদেরকে বলেন অথচ তিনি সবকিছু জানেন- তোমরা আমার বান্দার নামাজ দেখ; সেকি নামাজ পূর্ণভাবে আদায় করেছে- নাকি নামাজে ঘাটতি করেছে। যদি পূর্ণভাবে আদায় করে থাকে তাহলে পূর্ণ নামাজ লেখা হয়। আর যদি কিছু ঘাটতি থাকে তখন বলেন, দেখ আমার বান্দার কোনো নফল নামাজ আছে কিনা। যদি নফল নামাজ থাকে তখন বলেন, নফল নামাজ দিয়ে বান্দার ফরজের ঘাটতি পূর্ণ কর। এরপর অন্য আমলের হিসাব নেওয়া হবে’ (আবু দাউদ)। হজরত সুফিয়ান সাওরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি মক্কায় ৩ বছর ছিলাম। মক্কাবাসীর মধ্য থেকে জনৈক ব্যক্তি প্রত্যহ জোহরের সময় মসজিদে হারামে এসে বাইতুল্লাহ তওয়াফ করার পর নামাজ পড়ে আমাকে সালাম দিয়ে চলে যায়। ফলে তার ও আমার মাঝে হৃদ্যতা ও সম্প্রীতির সৃষ্টি হয়। হঠাৎ সে অসুস্থ হয়ে পড়লে আমাকে ডাকল এবং বলল, আমি মারা গেলে তুমি আমাকে নিজ হাতে গোসল দেবে, নামাজ পড়বে এবং দাফন দেবে। ওই রাতে তুমি আমাকে কবরে একাকী রেখে চলে আসবে না। তুমি আমার কবরের কাছে রাতযাপন করবে এবং মুনকার-নকিরের সওয়ালের সময় আমাকে সহায়তা করবে। সুতরাং আমি তাকে নিশ্চয়তা দিই। আমি তার আদেশ মোতাবেক তার কবরের কাছে রাতযাপন করি। আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলাম। হঠাৎ ঘোষকের ঘোষণা শুনলাম, হে সুফিয়ান, তোমার রক্ষণাবেক্ষণ ও তালকিনের প্রয়োজন নেই। আমি বললাম, কীসের জন্য? তিনি বললেন, রমজানের রোজা এবং রমজান-পরবর্তী শাওয়ালের ৬টি রোজার কারণে। আমি ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। ওজু করে নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পরলাম। অতঃপর আমি আবার একই স্বপ্ন দেখলাম। সুতরাং আমি উপলব্ধি করলাম যে, এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে, শয়তানের পক্ষ থেকে নয়। সুতরাং আমি চলে গেলাম এবং বলতে লাগলাম, হে আল্লাহ! আপনি আমাকে রমজানের রোজা এবং শাওয়ালের ৬টি রোজা রাখার তৌফিক দান করুন।
শাওয়ালের ৬ রোজার মাসয়ালা
শাওয়ালের ৬ রোজা এবং রমজানের কাজা রোজা এক সঙ্গে এক নিয়তে আদায় করলে শুধুমাত্র রমজানের রোজা আদায় হবে শাওয়ালের সুন্নত রোজা আদায় হবে না। রমজানের কাজা রোজা আদায় করা ফরজ যা কোরআন শরিফ দ্বারা প্রমাণিত। আর শাওয়ালের ৬ রোজা আদায় করা সুন্নত বা মুস্তাহাব যা হাদিছ দ্বারা প্রমাণিত। যখন দু’টি ভিন্ন ভিন্ন রোজা একটি অপরটির ওপর গুরুত্ব ও মর্যাদা হিসেবে প্রাধান্য পাবে তখন যেটি প্রাধান্য পাবে সেটি আদায় হয়ে যাবে অন্যটি আদায় হবে না। যদি কেউ একই রোজার মধ্যে রমজানের কাজা রোজা এবং মান্নতের রোজার নিয়ত করে তবে ইস্তেহসান হিসেবে রমজানের কাজা রোজা আদায় হবে।
> নারীদের পিরিয়ডের জন্য কাজা রোজা রেখে তার পরে শাওয়ালের ৬ রোজা রাখা যায় অথবা আগে শাওয়াল মাসের ৬ রোজা রেখে তার পরে বছরের সুবিধামত অন্য সময়ে কাজা রোজা আদায় করা যায়। দুটোই জায়েজ, যার কাছে যেটা সুবিধাজনক সেভাবে রোজা পালন করবেন, তবে জেনে রাখা ভালো, আগে কাজা রোজা আদায় করা উত্তম। কারণ, কাজা রোজা আদায় করা ফরজ আর শাওয়াল মাসের ৬ রোজা রাখা সুন্নত। তবে কারো যদি এমন কোনো ওজর থাকে যার ফলে তিনি শাওয়াল মাসে রমজানের কাজা রোজা রাখতে গিয়ে শাওয়ালের ৬ রোজা রাখতে পারেননি। যেমন- অসুস্থতা, সফর বা নারীদের বিশেষ কোনো শারীরিক অবস্থায় নিফাস (প্রসবোত্তর স্রাবগ্রস্ত) হন এবং গোটা শাওয়াল মাস তিনি রমজানের রোজা কাজা করেন তাহলে তিনি জিলকদ্ব মাসে শাওয়ালের ৬ রোজা রাখতে পারবেন। কারণ এ ব্যক্তির ওজর শরিয়তে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু কোনো ওজর ছাড়া কেউ যদি ৬ রোজা না রাখে এবং শাওয়াল মাস শেষ হয়ে যায় তাহলে সে ব্যক্তি এর সওয়াব পাবেন না। বান্দার ওপর আল্লাহর কত দয়া যে তিনি অল্প আমলের বিনিময়ে অধিক বদলা দেবেন। এ রোজা করা যাবে মাসের শুরু-শেষ-মাঝামাঝি সব সময়। ধারাবাহিক ও অধারাবাহিক, পরপর ৬টি রোজা রাখতে হবে এমন কোনো কথা নেই। যেভাবেই করা হোক না কেন রোজাদার অবশ্যই এর সওয়াবের অধিকারী হবে যদি আল্লাহর কাছে কবুল হয়। মহান শরিয়ত প্রণেতা ফরজের আগে-পরে নফল প্রবর্তন করেছেন যেমন- ফরজ সালাতের আগে-পরের সুন্নতগুলো এবং রমজানের আগে শাবানের রোজা আর পরে শাওয়ালের রোজা। এই নফলসমূহ ফরজের ত্রুটিগুলোর ক্ষতি পূরণ করে। কারণ রোজাদার অনর্থক বাক্যালাপ, কুদৃষ্টি প্রভৃতি কাজ থেকে সম্পূর্ণ বাঁচতে পারে না যা তার রোজার পুণ্যকে কমিয়ে দেয়।