ভুট্টার বৈশ্বিক রপ্তানির প্রায় ১৫ শতাংশ সরবরাহ করে থাকে রাশিয়া ও ইউক্রেন। এর মধ্যে ইউক্রেন সরবরাহ করে ১৩ শতাংশ, দুই শতাংশ রাশিয়া। যুদ্ধের কারণে এই দুই দেশের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে।
- প্রাণীখাদ্য তৈরিতে ফিড ইন্ডাষ্ট্রিতে প্রতি বছর ভুট্টার প্রয়োজন ৩৫–৩৬ লাখ টন
- ফিড ইন্ডাষ্ট্রিতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন থেকে চাহিদা পূরণ হয় প্রায় ৪০ শতাংশ, বাকিটা আমদানি নির্ভর
- ভারত থেকে ৫৯.১৯ এবং ব্রাজিল থেকে ২৭.৯৯ শতাংশ ভুট্টা আমদানি হয়
- বিশ্বের বিভিন্ন দেশ প্রাণীখাদ্য তৈরিতে ভুট্টার বিকল্প হিসেবে ব্রোকেন রাইস কিনছে, ফলে পণ্যটির দামও বাড়ছে
- দেশের ভুট্টার বিকল্প হিসেবে ব্রোকেন রাইস বা রাইস পলিশ ব্যবহার হলে চালের উপর চাপ তৈরি হবে
বিশ্বব্যাপী ভুট্টার সরবরাহের সংকট এবং ক্রমবর্ধমান দামের কারণে স্থানীয় গবাদি পশু এবং হাঁস-মুরগির খাদ্য উৎপাদনকারীরা উৎপাদন লাইনে শস্যের জায়গায় চাল ব্যবহার শুরু করেছেন। এটি ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলবে স্থানীয় বাজারে। ভুট্টার দুই রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে জড়ানোর কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তে শুরু করেছে পণ্যটির দাম। একদিকে বাড়তি দাম, অন্যদিকে সরবরাহ কম থাকায় বিপাকে পড়ছে আমদানিকারক দেশগুলো। বিশ্বব্যাপী প্রাণীখাদ্য তৈরির জন্য ভুট্টা ব্যবহারকারী অনেক দেশই এখন বিকল্প হিসেবে ব্রোকেন রাইস বা রাইস পলিশ ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। ব্লুমবার্গের তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে আন্তর্জাতিক বাজারে ২৫ কেজি ভুট্টার দাম ছিল ৬.৬ ইউএস ডলার। যা এখন ৭.৬ ডলারে উঠেছে।
ইউএসডিএ এর তথ্য বলছে, ভুট্টার বৈশ্বিক রপ্তানির প্রায় ১৫ শতাংশ সরবরাহ করে থাকে রাশিয়া ও ইউক্রেন। এর মধ্যে ইউক্রেন সরবরাহ করে ১৩ শতাংশ, দুই শতাংশ রাশিয়া। যুদ্ধের কারণে এই দুই দেশের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে বাংলাদেশের ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ফিড তৈরিতে ভুট্টার বিকল্প হিসেবে পলিশ রাইস বা ব্রোকেন রাইসের ব্যবহার কিছুটা বাড়ানো যাবে। তবে সম্পূর্ণরূপে ভুট্টার ব্যবহার বন্ধের উপায় নেই। আবার পলিস রাইস বেশি ব্যবহার করতে গেলে সেক্ষেত্রে স্থানীয় চালের সরবরাহে ঘাটতির সম্ভাবনা তৈরি হবে। বাংলাদেশের ফিড উৎপাদনকারীরা বলছেন, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম উৎপাদনের জন্য যে খাদ্য তৈরি করা হয় তার মধ্যে প্রায় ৫৫-৬০ শতাংশ ভুট্টার ব্যবহার করা হয়। আর ১০ শতাংশের মত ব্যবহার হয় পলিশ রাইস। ভুট্টার ব্যবহার যদি কমে তবে বাংলাদেশেও পলিশ রাইসের ব্যবহার স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা বাড়তে পারে। ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ফিয়াব) এর প্রেসিডেন্ট ইহতেশাম বি শাহজাহান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “ভুট্টার বিকল্প হিসেবে পলিশ রাইসের ব্যবহার কিছুটা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। তবে দুটি পণ্যে একই ধরনের পুষ্টিগুণ না থাকায় পুরোপুরি ব্যবহার কমিয়ে দেওয়া সম্ভব না।”
ফিয়াব-এর তথ্য বলছে, ভুট্টার দাম করোনার আঘাতের পর থেকেই বাড়তে শরু করেছে। এখন আবার তা যুদ্ধের কারণে বাড়ছে। ২০২০ সালে প্রতি কেজি ভুট্টার দাম ছিল ২৮.১৭ টাকা, যা ২০২২ সালে ২৮ টাকা এবং বর্তমানে প্রায় ৩৩ টাকায় উঠেছে। অর্থাৎ এই দুই বছরে ভুট্টার দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। একই সঙ্গে পলিশ রাইসের দাম বেড়েছে ৭১ শতাংশ। সয়াবিন মিলের দাম বেড়েছে ৮৮ শতাংশ। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৬০-৬৫ লাখ টন প্রাণীখাদ্য তৈরি হয়। এই প্রাণীখাদ্য তৈরিতে সবচেয়ে বেশি ৫৫-৬০ শতাংশ ব্যবহার হয় ভুট্টা, ১০ শতাংশ পলিশ রাইস, ২৫-৩০ শতাংশ ব্যবহার হয় সয়াবিন মিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন মিল ও সয়াবিন তেলের দাম বাড়তে থাকে। নিজেদের স্টক বাড়াতে সয়াবিনের বড় রপ্তানিকারক দেশ আর্জেন্টিনা সয়াবিনের রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেয়। এর প্রভাবও পড়ছে প্রাণীখাদ্য তৈরিতে। ইহতেশাম বি শাহজাহান জানান, ভুট্টার দাম বৃদ্ধি ফিড উৎপাদনকারীদের ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু ফিডের দাম বাড়ানো যাচ্ছে না। করোনা শুরু হওয়ার পর থেকেই ফিডের উপাদানগুলোর দাম বেড়েছে গড়ে ৮০ শতাংশ।সেসময় ফিডের দাম বাড়ানো হয়েছে ২০-২৫ শতাংশ। কিন্তু সে অনুযায়ী ব্রয়লার মুরগি, ডিম, দুধের দাম বাড়েনি। “এখন নতুন করে ফিডের দাম আরও বাড়লে চাপে থাকা খামারিরা ব্যবসা ছেড়ে দেবে,” বলেন তিনি।
ভুট্টার সরবরাহ কম, চাল আমদানি বাড়াবে চীন
রয়টার্সে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাণীখাদ্য তৈরির জন্য ভুট্টার বিকল্প হিসেবে এশিয়া অঞ্চল থেকে ব্রোকেন রাইস বা পলিশ রাইস কিনছে চীন। যার প্রভাবে ভারতে ব্রোকেন রাইসের দাম টনপ্রতি ২৯০ ডলার থেকে ৩২০ ডলারে উঠে গেছে। এদিকে ইউএসডি এর তথ্য বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক দেশ হচ্ছে চীন। দেশটি ২০২০-২১ বছরে ২৯.৫১ মিলিয়ন টন ভুট্টা আমদানি করেছে। যেখানে বাংলাদেশ বৈশ্বিক রপ্তানির ১ শতাংশ আমদানি করে। রয়টার্সের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চলতি বছরের জন্য ইউক্রেনীয় ভুট্টার দুই মিলিয়ন টন পর্যন্ত বুক করেছিল চীন। কিন্তু ইউক্রেনের লজিস্টিক চেইনগুলোতে ব্যাঘাতের কারণে সেই চালানের বেশিরভাগই এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ,এই হারানো ভলিউম প্রতিস্থাপন করতে, চীন প্রায় তিন মিলিয়ন টন ভাঙ্গা চাল আমদানি করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে ভুট্টার মূল রপ্তানিকারক ভারত
বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ভুট্টা আমদানি করে ভারত থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০-২১ বছরে ভারত থেকে ৫৯.১৯ শতাংশ, ব্রাজিল থেকে ২৭.৯৯ শতাংশ, আর্জেন্টিনা থেকে ৪.৪২ শতাংশ, ইউক্রেন থেকে ১ শতাংশ ভুট্টা আমদানি করা হয়েছে। এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে এখন ভুট্টার উৎপাদন ৫৫ লাখ টনের বেশি। কিন্তু চাহিদা রয়েছে প্রায় ৬৫ লাখ টনের। তবে বাংলাদেশে যে পরিমাণ ভুট্টার উৎপাদন তা থেকে ফিড তৈরির উপযোগী এবং প্রয়োজনীয় সব ভুট্টা পাওয়া যায় না। ফিড উৎপাদনকারীরা প্রতি বছর প্রায় ৩৫-৩৬ লাখ টন ভুট্টা ব্যবহার করে। যার ৪০ শতাংশ স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করে। বাকিটা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়।