ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার বাধ্যবাধকতা ও কভিড মহামারির প্রভাবে ২০২০ সালে পরিচালন মুনাফায় ধস নেমেছিল দেশের ব্যাংক খাতে। তবে বছরের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোর আয় খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বেড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। পাশাপাশি আমদানি রপ্তানিও। এসব নিয়ামকের ওপর ভর করে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) দেশের বেশিরভাগ ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। সুদ খাতের আয় নয়, বৈদেশিক বাণিজ্যের কমিশনসহ বিভিন্ন সেবার বিপরীতে প্রাপ্ত ফি-ই ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার বড় উল্লম্ফনে ভূমিকা রেখেছে। পাশাপাশি কস্ট অব ফান্ড বা আমানতের সুদহার কমিয়ে আনার প্রভাবও দেখা গেছে। যে ব্যাংক আমানতের সুদ যত বেশি কমাতে পেরেছে, সে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় তত বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার বড় প্রবৃদ্ধিকে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর বার্তা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সাউথইস্ট ব্যাংক চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ৫৩৩ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছে। গত বছরের একই সময়ে যা ছিল ৪৭২ কোটি টাকা। এছাড়া মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মুনাফার পরিমাণ ৩৯৫ কোটি, যা আগের বছরে ছিল ৩৫৮ কোটি। আলোচ্য সময়ে ঢাকা ব্যাংক ৩৭৫ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করেছে। আগের বছরে যা ছিল ৩০৯ কোটি।প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ১৬৫ কোটি টাকা; যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ কোটি টাকা বেশি। এই সময়ে এনসিসি ব্যাংকের আয় ছিল ৩৭৭ কোটি, আগের বছর যা ছিল ২৮৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংক ২০২২ সালের প্রথম ষাণ¥াসিকে (জানুয়ারি-জুন) ১০০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে, এর আগের বছরের একই সময়ে ব্যাংকের মুনাফা ছিল ৮০ কোটি টাকা। সে হিসেবে ছয় মাসে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা বেড়েছে ২০ কোটি টাকা বা ২৫ শতাংশ।আলোচ্য সময়ে এক্সিম ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ছিল ৩৭৫ কোটি। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৩৫০ কোটি। এ সময়ে ১২৮ কোটি টাকা করেছে মধুমতি ব্যাংক। আগের বছরে যা ছিল ৮৩ কোটি। পূবালী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় এসেছে বড় পরিবর্তন। কারণ এ বছরের প্রথম ছয় মাসে ৬৫০ কোটি টাকা লাভ করেছে ব্যাংকটি। আগে বছরের একই সময়ে যা ছিল ৫০৩ কোটি টাকা। হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংকটি মুনাফা বেড়েছে ১৪৭ কোটি টাকা। প্রিমিয়ার ব্যাংকের মুনাফা ছিল ৩৮৫ কোটি টাকা, আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৩০০ কোটি। বরাবরের মতো ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি পরিচালন মুনাফা করেছিল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ব্যাংকটি ২০২১ সালে ২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জন করে। ২০২০ সালে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। ২০২১ সালে হাজার কোটি টাকার বেশি পরিচালন মুনাফা অর্জনকারী ব্যাংকগুলোর তালিকায় ছিল পূবালী, দি সিটি, ইস্টার্ন, সাউথইস্ট, ব্যাংক এশিয়া ও ব্র্যাক ব্যাংকের নাম। তবে দেশের বড় ব্যাংকগুলোর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে। ২০২১ সালে মাত্র ২৪৮ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা দেখাতে পেরেছে ব্যাংকটি। যদিও ২০২০ সালে ৯২০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জনের দাবি করেছিল ন্যাশনাল ব্যাংক। পরিচ্ছন্ন হিসাবের কারণে এবার ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা কমেছে বলে ব্যাংকটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে যে মুনাফা থাকে, সেটিই কোনো ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা। পরিচালন মুনাফা কোনো ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। এ মুনাফা থেকে খেলাপি ঋণ ও অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ এবং সরকারকে কর পরিশোধ করতে হয়। প্রভিশন ও কর-পরবর্তী এ মুনাফাই হলো একটি ব্যাংকের প্রকৃত বা নিট মুনাফা। বাংলাদেশ ব্যাংকের মার্চ প্রান্তিকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত আট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। তবে কয়েকটি ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রেখে দেয়ায় ঘাটতির হিসাবে কম লক্ষ করা গেছে। আর উদ্বৃত্ত সঞ্চিতি রক্ষার ফলে মোট সঞ্চিতির ঘাটতি কমে ১৪ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা হয়েছে, যা গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ছিল ১৪ হাজার ৩৭ কোটি টাকা।