প্রায় এক যুগ যাবত বিভিন্ন ছদ্মবেশে ব্যাংক ডাকাতি ও স্বর্ণালংকার লুটকারী চক্রের মূলহোতা রাজা মিয়া’সহ ০৩ জনকে মুন্সিগঞ্জ ও বরিশাল হতে গ্রেফতার করেছে র্যাব। উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ লুটকৃত স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ অর্থ।
১। র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, র্যাব এলিট ফোর্স হিসেবে আত্মপ্রকাশের সূচনালগ্ন থেকেই বিভিন্ন ধরণের অপরাধ নির্মূলের লক্ষ্যে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে আসছে। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূল ও মাদকবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি খুন, চাঁদাবাজি, চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই চক্রের সাথে জড়িত বিভিন্ন সংঘবদ্ধ ও সক্রিয় সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের গ্রেফতার করে সাধারণ জনগণের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে র্যাবের জোড়ালো তৎপরতা অব্যাহত আছে।
২। গত ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখ রাতে রাজধানীর কচুক্ষেতের রজনীগন্ধা টাওয়ারের নিচতলায় রাঙাপরী জুয়েলার্স নামে একটি স্বর্ণের দোকান থেকে প্রায় ৩০০ ভরি স্বর্ণ লুটের একটি দুর্ধর্ষ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় রাঙাপরী জুয়েলার্সের মালিক আবুল কালাম ভূঁইয়া ভাষানটেক থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নং ০৭, তারিখ ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২। ধারা ১৮৬০ সালের পেনাল কোড ৪৬১/৩৮০। উক্ত ঘটনাটি বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াসহ এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে। পরবর্তীতে র্যাব ঘটনার বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত ও সিসিটিভি ফুটেজসহ বিভিন্ন ঘটে যাওয়া লুটের ঘটনা ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে আসামী সনাক্তের কাজ এবং গোয়েন্দা নজরদারী অব্যাহত রাখে।
৩। এরই ধারাবাহিকতায় গত ০৪ এপ্রিল ২০২২ তারিখ র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৪ এর দুটি বিশেষ আভিযানিক দল মুন্সিগঞ্জ ও বরিশালে অভিযান পরিচালনা করে স্বর্ণালংকার লুট চক্রের মূলহোতা (১) মোঃ কাউসার হোসেন@ বাচ্চু মাস্টার (৪২), পিতাঃ শেখ হযরত আলী, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল ও তার সহযোগী (২) মোঃ রাজা মিয়া (৫৪), পিতাঃ ভোলা মিয়া, শ্রীনগর, মুন্সিগঞ্জ এবং (৩) মোঃ মাসুদ খান (৪২), পিতাঃ সুলতান উদ্দিন খান, রাজাপুর, ঝালকাঠি’দেরকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করা হয় লুটকৃত ১৯.৭০ গ্রাম স্বর্ণ ও নগদ ৩,২৯,১৮০/-টাকা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা বর্ণিত স্বর্ণের দোকানে ডাকাতিতে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে।
৪। গ্রেফতারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র্যাব জানতে পারে যে, তারা ইতোপূর্বে বিভিন্ন মামলায় র্যাবের হাতে একাধিকবার আটকের পর বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেছে। এই চক্রটির অপরাধের ধরণ বিশ্লেষনে দেখা যায়, তারা প্রথমে ভূয়া জাতীয় পরিচয়পত্র, নাগরিক সনদপত্র ইত্যাদি ব্যবহার করে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে তাদের লক্ষ্যবস্তু দোকান সমূহে মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে যোগদান করে বা দোকান ভাড়া নেয়। পরবর্তীতে স্বর্ণালংকার লুট করার পর তারা আত্মগোপণে চলে যায় ও নিজেদের মধ্যে সর্বপ্রকার যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। পর্যায়ক্রমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা কিছুদিন পর নতুন লক্ষ্যবস্তু ঠিক করার জন্য পুনরায় যোগাযোগ করে।
একই পদ্ধতিতে তারা ২০১৪ সালে ব্রাক ব্যাংক এর জয়পুরহাট শাখার ভল্ট ভেঙ্গে ০১ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকা লুট করে। এই ঘটনায় তারা ব্যাংকের পাশের একটি ঘর একটি এনজিও’র নামে মিথ্যা পরিচয়ে ভাড়া নেয়। ভল্ট লুটের ০১ সপ্তাহ আগে থেকে স্ক্রু ড্রাইভার ও শাবল দিয়ে দেয়াল কেটে ব্যাংকের ভল্টে ডুকে ঐ টাকা লুট করে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে র্যাবের অভিযানে রাজা মিয়াসহ ০৭ জন গ্রেফতার হয়। ঐ ঘটনায় রাজা মিয়া ০৩ বছর কারাভোগ করে। একইভাবে তারা ২০১৮ সালে সিদ্ধিরগঞ্জে দুইটি স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি করে ৪৫৫ ভরি স্বর্ণ ও ০২ লক্ষ টাকা লুট করে। পরবর্তীতে র্যাবের অভিযানে তারা ০৩ জন গ্রেফতার হয় এবং কারাভোগ করে। গ্রেফতারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানায় যে, তারা ২০২০ সালে ডেমরার হাজী হোসেন প্লাজায় স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি করে ২৩০ ভরি স্বর্ণ ও ১.৫ লক্ষ টাকা লুট করে। উক্ত ঘটনার আনুমানিক দুই মাস পূর্বে এই চক্রের ০৩ সদস্য মিথ্যা পরিচয়ে একটি সিকিউরিটিজ কোম্পানীর গার্ড হিসেবে মার্কেটের নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে যোগ দেয়। এতদিন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে তারা গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম ছিল।
৫। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা আরও জানায় যে, তারা সংঘবদ্ধ ব্যাংক ডাকাতি ও স্বর্ণালঙ্কার লুট চক্রের সক্রিয় সদস্য। এই চক্রের সদস্য সংখ্যা ৮-১০ জন। গ্রেফতারকৃতরা সকলেই বিভিন্ন পেশার আড়ালে দীর্ঘদিন যাবৎ পারস্পারিক যোগসাজসে দেশের বিভিন্ন স্থানের স্বর্ণের দোকান লুট, ব্যাংক ডাকাতি ও বিভিন্ন মার্কেটে লুট করে আসছে। গ্রেফতারকৃত কাউসার বর্ণিত ঘটনায় রাজধানীর কচুক্ষেত এলাকায় রজনীগন্ধা মার্কেটে স্বর্ণের দোকান লুটের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঘটনার দেড় মাস পূর্বে উক্ত মার্কেটে ভূয়া পরিচয়ে ০১টি দোকান ভাড়া নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী সে তার ভাড়াকৃত দোকানে নাম সর্বস্ব মালামাল রেখে কৌশলে চুরির কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জামাদি মজুদ করে।
৬। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক লুট চক্রের মূলহোতা গ্রেফতারকৃত রাজা মিয়া ও তার সহযোগী কাউসার মাস্টারসহ অজ্ঞাত আরো ৩-৫ জন সদস্য রাত আনুমানিক ১২.০০ ঘটিকায় মিরপুর-১৪, গোলচত্বরে একত্রিত হয়। গ্রেফতারকৃত মাসুদ তাদেরকে ০১.০০ ঘটিকা নাগাদ মার্কেটে আসতে বলে। এই সময়ের মধ্যে গ্রেফতারকৃত মাসুদ মার্কেটের অন্যান্য নিরাপত্তাকর্মীদের কৌশলে খাবার ও পানীয়ের সাথে চেতনানাশক সেবন করিয়ে তাদের অজ্ঞান করে। পরিকল্পনা মোতাবেক অন্যান্যরা মার্কেটের সামনে আসলে মাসুদ ও তার এক সহযোগী গেটের তালা খুলে তাদেরকে কাউসার এর ভাড়াকৃত দোকানের ভিতর নিয়ে যায়। কাউসার মাস্টার ও তার এক সহযোগী মার্কেটের বাইরের চারপাশ নজরদারিতে থাকে। পরবর্তীতে রাত আনুমানিক ০২.০০ ঘটিকার সময় কাউসার মাস্টারের দোকান হতে পূর্ব থেকে মজুদ করে রাখা তালা ভাঙ্গার যন্ত্রপাতি দিয়ে দুটি দোকানের তালা এবং শাটার ভেঙ্গে রাজা মিয়াসহ আরও ২/৩ জন দোকানের ভিতর প্রবেশ করে। দোকানের ভিতর থাকা স্বর্ণলংকার ও নগদ টাকা লুট করে তাদের ভাড়াকৃত দোকানে নিয়ে যায়। ঘটনা চলাকালীন সময়ে মাসুদ দোকানের বাহিরে পাহারা দেয়। দোকানে যে স্বর্ণালঙ্কার লুট হয়েছে তা যেন আগে থেকে না বুঝা যায় সে জন্য তারা দোকানে নতুন তালা লাগিয়ে দেয়। অতঃপর ভোরে লুটকৃত মালামালসহ কেরানীগঞ্জে কাউসার মাস্টার এর পূর্ব থেকে ভাড়াকৃত বাসায় চলে যায়।
৭। গ্রেফতারকৃতরা আরও জানায় যে, ঘটনার দিন সকালেই তারা লুটকৃত স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকা, নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে তাদের গ্রামের বাড়ি চলে যায়। এ চক্রের মূলহোতা গ্রেফতারকৃত রাজা মিয়া একজন দক্ষ তালা ভাঙ্গার মেকার এবং অন্যান্যরা বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী। গ্রেফতারকৃতরা খুব সাধারণ বেশভূষা ধারণ করে চলাফেরা করত যেন কেউ তাদেরকে কোনো প্রকার সন্দেহ না করে।
৮। গ্রেফতারকৃত কাউসার মাস্টার সকল প্রকার ভূয়া কাগজপত্র তৈরি করে রাজধানীর মিরপুরের একটি সিকিউরিটি এজেন্সির নাম ব্যবহার করে মাসুদকে রজনীগন্ধা মার্কেটে সিকিউরিটি গার্ড এ চাকুরির ব্যবস্থা করে দেয়। চাকুরিতে যোগদানের পর থেকেই তারা বিভিন্ন সময়ে মার্কেটের সিকিউরিটিসহ অন্যান্য বিষয়ের খোঁজ খবর নিতে থাকে এবং স্বর্ণের দোকান লুটের পরিকল্পনা করতে থাকে। রাজা মিয়া তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাউসারের ভাড়াকৃত দোকানে নাম সর্বস্ব মালামাল রেখে কৌশলে লুটের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জামাদি মজুদ করে।
৯। গ্রেফতারকৃত রাজা মিয়া ১৯৯০ সালে বাসের কন্ডাক্টর হিসেবে কাজ শুরু করে। ২০০২ সালের দিকে বর্ণিত সংঘবদ্ধ চক্রটির সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠে এবং সেই থেকেই সে অপরাধে জগতে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে বাস কন্ডাক্টরির পরিবর্তে অটোরিক্সা চালানো শুরু করে। সে অটো রিক্সা চালানোর আড়ালে পরিকল্পনামত লুট/ডাকাতির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মার্কেটে রেকি করত। গ্রেফতারকৃত রাজা মিয়া একজন দক্ষ তালা-চাবির মেকার। সে অর্ধ-শতাধিক চুরি/ডাকাতির ঘটনায় জড়িত বলে স্বীকারোক্তি প্রদান করেছে। বর্ণিত ঘটনায় সে দোকানে লুটের পরিকল্পনা করে এবং লুটের সময় স্বর্ণের দোকানে শার্টারের তালা ভাঙ্গার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। ইতোপূর্বে তার নামে চুরি ও ডাকাতি সংক্রান্ত ০২টি মামলায় কারাভোগ করেছে।
১০। গ্রেফতারকৃত কাউসার হোসেন মাধ্যমিক সম্পন্ন করে আরআরএমপির একটি প্রকল্পে চাকুরি নেয়। পরবর্তীতে ২০০৯ সাল হতে ঢাকায় এক আইনজীবীর অফিস সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করে। ২০১৮ সালে মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে সংঘবদ্ধ ডাকাতি ও স্বর্ণালঙ্কার লুট চক্রের এক সদস্য আদালতে আসলে সেখানে কাউসার এর সাথে পরিচয় হয়। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। ২০১৮ সালে সিদ্ধিরগঞ্জের স্বর্ণালঙ্কার লুটে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে এবং র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করে। অপরাধ জগতে বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এবং ভুয়া সকল কিছু তৈরি করতে সিদ্ধ বিধায় তাকে তাদের চক্রের সকল সদস্য মিলে মাস্টার উপাধি দেয়।
১১। গ্রেফতারকৃত মাসুদ ঢাকার চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে ক্লিনার ও বয় হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করে। চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে চাকুরী করা অবস্থায় ২০১০ সালের দিকে এই চক্রের সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরে সখ্যতা গড়ে তোলে। সে ২০১৬ সালে নারায়নগঞ্জে একটি গার্মেন্টসে চাকুরী নেয়। ২০১৮ সাল পর্যন্ত নারায়নগঞ্জে থাকা অবস্থায় নারায়নগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন হাজী আহসান উল্লাহ সুপার মার্কেটের ০২ টি স্বর্ণের দোকানের প্রায় ০২ কেজি স্বর্ণ লুট করে। সেই লুটের ঘটনায় সে কারাবরণ করে। তার নামে ০৩ টি চুরির মামলা রয়েছে।
১২। গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।