২০০৬ সাল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড়পুকুরিয়ার কয়লা ব্যবহার করছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সে সময় প্রতি টন কয়লার দাম ধরা হয়েছিল ৬০ ডলার। পরে তা চার দফা বাড়িয়ে ১০ বছরের মধ্যে করা হয় ১৩০ ডলার। এর পর ছয় বছর আর কয়লার দাম বাড়ানো হয়নি। তবে এবার কয়লার দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি।নতুন প্রস্তাবে প্রতি টন কয়লার দাম ২১০ দশমিক ৪৫ ডলার নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করা হলে কয়লার দাম বাড়বে প্রায় ৬২ শতাংশ। এতে বড়পুকুরিয়া কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন পিডিবির কর্মকর্তারা। বড়পুকুরিয়ার কয়লার দাম নিয়ে সম্প্রতি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে। এতে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা করা হয়। পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে আমদানি করা কয়লার দামের তুলনা তুলে ধরা হয়। বৈঠকে বলা হয়, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর কর্তৃক ১৯৮৫ সালে আবিষ্কৃত হয়। আর খনির খননকাজ শেষে ২০০৫ সালে ঠিকাদারের কাছ থেকে বুঝে নেয়া হয়। ওই বছর ১০ সেপ্টেম্বর থেকে খনিটি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কয়লা উত্তোলন শুরু করা হয়। ২০০৫-০৬ অর্থবছর থেকে পিডিবিসহ অন্যান্য খাতে কয়লা বিক্রি শুরু করা হয়। তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০১৮ সালের ১৯ মার্চ থেকে স্থানীয় ক্রেতাদের কাছে কয়লা বিক্রি বন্ধ রাখা হয়। সে সময় থেকে শুধু পিডিবির কাছেই বড়পুকুরিয়ার কয়লা বিক্রি করা হচ্ছে। খনিটি থেকে উত্তোলনের শুরুতে পিডিবির জন্য প্রতি টন কয়লার দাম নির্ধারণ করা হয় ৬০ টন। ২০০৮ সালের ১ জুলাই তা বাড়িয়ে ৭০ ডলার, ২০১০ সালের ১ জুলাই ৮৪ ডলার, ২০১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ১০৫ ডলার এবং ২০১৫ সালের ১ মে ১৩০ ডলার দাম নির্ধারণ করা হয়। সে সময় দেশীয় মুদ্রায় প্রতি টন কয়লার দাম নেয়া হতো ১০ হাজার ১৮৬ টাকা। তবে ডলারের বিনিময় হার পরিবর্তনের কারণে বর্তমানে তা নেয়া হচ্ছে ১২ হাজার ১৫৫ টাকা। যদিও বেসরকারি খাতে কয়লার দাম সবসময়ই পিডিবির চেয়ে বেশি নেয়া হতো। বৈঠকে জানানো হয়, বর্তমানে প্রতি টন কয়লা উৎপাদনে ব্যয় হচ্ছে ১৩৭ দশমিক ৯২ ডলার। তবে এ কয়লার দাম ২১০ দশমিক ৪৫ ডলার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর কারণ হিসেবে সভায় জানানো হয়, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির কার্যক্রম উত্তর দিকে আরও বর্ধিত করার জন্য অতিরিক্ত স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে। এজন্য ৩০০ একর জমি অধিগ্রহণে আনুমানিক এক হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। এতে স্থাপনাসহ জমি অধিগ্রহণ বাবদ আগামী ছয় বছরে প্রতি টন কয়লা উত্তোলনে ব্যয় বাড়বে প্রায় ২৮ দশমিক ৭৭ ডলার।বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির আওতায় বেশ কয়েকটি কয়লা ক্ষেত্রে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে উৎপাদনের ব্যয়ের ১৫ শতাংশ। এ বাবদ প্রতি টনে ব্যয় বাড়বে ২০ দশমিক ৬৯ ডলার। এছাড়া কয়লার দামের ওপর করের হার বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ খাতে ব্যয় বেড়েছে শূন্য দশমিক ৬৮ ডলার। আর ডলারের বিনিময় হার পরিবর্তন বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ১ দশমিক ৭০ ডলার। পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয়ের ২০ শতাংশ তথা ২০ দশমিক ৬৯ ডলার মুনাফা ধরা হয়েছে। দাম বৃদ্ধির ব্যাখ্যায় আরও জানানো হয়, ২০২০ সালের ৩ মার্চ কয়লার খনিমুখ মূল্যের রয়ালিটির হার পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। আর এ রয়ালিটির ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এতে রয়ালিটি ও ভ্যাট মিলিয়ে ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। আগে এ হার ছিল পাঁচ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এতে ১৩০ ডলারের ওপর অতিরিক্ত সাত দশমিক ৫৭ ডলার পরিশোধ করতে হচ্ছে। তাই প্রতি টন কয়লা দাম ৮০ দশমিক ৪৫ ডলার বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। বৈঠকে বেসরকারি বিভিন্ন ইটভাটার জন্য আমদানিকৃত কয়লার মূল্য তুলে ধরা হয়। এ সময় জানানো হয়, গত বছর ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানিতে ব্যয় হয়েছে টনপ্রতি ১৭ হাজার ৫০০ থেকে ১৮ হাজার ২৫০ টাকা, ভারত থেকে আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১৭ হাজার ২৫০ থেকে ১৭ হাজার ৭৫০ টাকা এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১৭ হাজার ৫০০ থেকে ১৮ হাজার ৫০০ টাকা। গড়ে দাম পড়েছে ১৭ হাজার ৭৭৪ টাকা। আর দিনাজপুর বা লালমনিরহাট পর্যন্ত নিয়ে যেতে পরিবহন ব্যয়সহ প্রতি টন কয়লার দাম পড়েছে গড়ে ১৮ হাজার ৮৩৫ টাকা। এদিকে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানি করা কয়লার দাম পড়েছে প্রতি টন ১৮০ ডলার। তবে এ কয়লার মান বড়পুকুরিয়ার কয়লার চেয়ে কম। আর বড়পুকুরিয়ার কাদামিশ্রিত কয়লা টেন্ডার আহ্বানের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে ১৯০ ডলারে। এগুলোয় আর্দ্রতার হার বেশি। তবে বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সরবরাহকৃত কয়লার মান অনেক উন্নত। এগুলোর দাম আন্তর্জাতিক বাজারের হিসাবে ৩০০ ডলার পড়বে। তাই বড়পুকুরিয়ার কয়লার দাম টনপ্রতি ২১০ দশমিক ৪৫ ডলার নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়। জানতে চাইলে বৈঠকে উপস্থিত পিডিবির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি গত কয়েক বছর ধরে চাহিদা অনুযায়ী কয়লা সরবরাহ করতে পারছে না। এজন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দুটি প্রায়ই বন্ধ রাখতে হয়। এর মধ্যে ৬২ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।তারা আরও জানান, প্রতি টন কয়লার দাম ২০ ডলার বাড়লে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়বে ইউনিটপ্রতি প্রায় এক টাকা। আর নতুন প্রস্তাবে ৮০ দশমিক ৪৫ ডলার দাম বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় চার টাকা বেড়ে যাবে। তাই বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়নি। উল্লেখ্য, ২০১৬-১৭ অর্থবছর বড়পুকুরিয়া খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হয়েছিল ১১ লাখ ৬০ হাজার ৬৫৮ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ অর্থবছর তা কমে দাঁড়ায় সাত লাখ ৫৩ হাজার ৯৭৩ মেট্রিক টন। বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে তিনটি ইউনিটের উৎপাদন সক্ষমতা ৫২৫ মেগাওয়াট। এজন্য প্রতিদিন কয়লার প্রয়োজন সাড়ে পাঁচ হাজার টন। কিন্তু খনিতে বর্তমানে দৈনিক উৎপাদিত হচ্ছে দুই থেকে তিন হাজার টন। এছাড়া খনির যে স্তর থেকে বর্তমানে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে, সেখান থেকে প্রতিদিন তিন হাজার টনের বেশি কয়লা পাওয়া সম্ভব নয়। এতে প্রতিদিন ঘাটতি থাকে আড়াই থেকে সাড়ে তিন হাজার টন। এর মধ্যে আবার বছরে শিফট পরিবর্তনের জন্য খনির কয়লা উত্তোলন তিন মাস বন্ধ থাকে।