১৯৭১ সালের ১লা মার্চ থেকে ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত সময়টি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ঘটনাবহুল অধ্যায়। এর মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ১৮ মিনিটের ভাষণের কারণে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ একটি উল্লেখযোগ্য মাত্রা যোগ করে। কোন কাগজ সমর্থন ছাড়াই দিন যা ছিল যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অপারেশন অর্ডার। সেই ভাষণের মধ্য দিয়ে যেন গেরিলা যুদ্ধে একজন অভিজ্ঞ সেনাপতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি। বক্তৃতার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য, কণ্ঠের উত্থান-পতন, আঙুলের কাত, সবকিছুই ছিল চুম্বকের মতো, আকর্ষণীয়, মোহনীয় এবং সর্বোপরি উপযুক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউজউইক ম্যাগাজিন ভাষণের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে 'রাজনীতির কবি' হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ভাষণের মাধ্যমে ৭ কোটি ৫০ লাখ মানুষকে স্বাধীনতার সবুজ সংকেত দিয়ে উচ্ছৃঙ্খল বাঙালিকে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দেন। তার নির্দেশের অপেক্ষায় জনতা।
কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়---
শত বছরের শত সংগ্রামের পর,
রবীন্দ্রনাথের মতো গর্বিত পদক্ষেপে
কবি অবশেষে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন |
তারপর এক পলকের মধ্যে, প্রবল জলে নৌকাটি প্লাবিত হল,
হৃদয়ে দোল খায়,
ভিড় সাগরে জোয়ার, সব দরজা খোলা-
কে থামাবে তার জ্বালাময়ী কথা?
গণ-অগ্নির মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি আবৃত্তি করলেন অমর কবিতা:
'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম |'
অনুবাদ করেছেন ড. মাসুম জেড. হাসান
ভারত বিভক্তির আগে এমনকি ভাষা আন্দোলনের আগেও বঙ্গবন্ধু প্রথম এদেশের মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন ১৯৪৬ সালে। তারপর ধাপে ধাপে দ্বি-জাতীয় তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত (পাকিস্তান ও ভারত) বিভক্তি, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা সেই কাঙ্খিত স্বাধীনতা পেয়েছি এবং স্বাধীন রাষ্ট্র 'বাংলাদেশ'-এর জন্ম হয়।
জাতির পিতা, বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই কণ্টকাকীর্ণ অসম পথের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা একই সুতোয় বাঁধা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সামরিক সরকারের অধীনে যা ১৯৫৮ সালে এইচএস সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করে, কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তৈরি করা শুরু করেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের অজুহাত।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে, পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে ঢাকায় আসেন। পশ্চিম পাকিস্তানি জান্তার ষড়যন্ত্রের ফলে পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে অসন্তোষ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। সেই ভাষণের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ৬ দফা দাবির ভিত্তিতে ন্যায্য স্বায়ত্তশাসন বা স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধীনতার আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণের শুরুতেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর দুই দশকের শোষণ-বঞ্চনার চিত্র এঁকেছিলেন। দেশের প্রতিটি সেক্টরে বাঙালিরা যে অবহেলিত হচ্ছে তার কথাও উঠে আসে তার বক্তব্যে। পাকিস্তানের উভয় শাখাই শেখ মুজিবুর রহমানকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসায়। আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সামরিক সরকার তাকে সরকার গঠন করতে দেয়নি। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে সারা পাকিস্তানে বিক্ষোভ হয়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য বঙ্গবন্ধু বারবার ক্ষমতাসীনদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সমগ্র বাংলায় অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসক সরকারের কৌশল বুঝতে পেরেছিলেন এবং বুঝতে পেরেছিলেন যে তারা তাদের অবস্থান থেকে ফিরে যাবে না, তাই শেখ মুজিবুর রহমান তার বক্তৃতার শেষের দিকে এসে ঘোষণা দেন। একটি বজ্রধ্বনি –
"এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”
এই ঐতিহাসিক ভাষণ স্বাধীনতার পরোক্ষ ঘোষণা। কারণ ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করব ইনশাআল্লাহ’ উক্তিটি তাৎক্ষণিক মুক্তিযুদ্ধের ইঙ্গিত বহন করে। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি কিন্তু আসন্ন যুদ্ধের মুখোমুখি হওয়ার জন্য জনগণকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। তাঁর ঘোষণা পাকিস্তানি দুঃশাসন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ ও উদ্বুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিল।
বাংলাদেশের হাইকোর্ট ৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখের একটি রায়ে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে `বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ’ অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি শাহেদনুর উদ্দিনের বেঞ্চ পাঠ্যপুস্তকে ভাষণটি অন্তর্ভুক্ত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বিশেষজ্ঞদের একটি কমিটি গঠন করতে বলেছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারকে হত্যার পর দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র `৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ নিষিদ্ধ করে। তাই শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপুমনি এমপি ও শিক্ষা উপ-শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এমপির গতিশীল নেতৃত্ব ও বলিষ্ঠ দিকনির্দেশনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিকতার সাথে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে হবে।
আমরা গর্বিত যে ভাষণের শেষ অংশ “জয় বাংলা” ইতিমধ্যেই জাতীয় শ্লোগানের মর্যাদা পেয়েছে।এই উদ্যোগের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ।আমি আশা করি হাইকোর্টের রায়ের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে `বঙ্গবন্ধুর` ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ' সব স্তরের পাঠ্য কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করা হবে যার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ভাষণ চিরকাল বাংলার মানুষের সার্বিক মুক্তি ও উন্নয়নের সনদ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
লেখক:
মোঃ আনোয়ার হাবিব কাজল
সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট