মনির খাঁন কুমিল্লা জেলা প্রতিনিধি :
কুমিল্লার অজপাড়া গ্রামের নারী শাহিনূর আক্তার এক দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে নিজ ছেলেকে মাফিয়াদের কবল থেকে উদ্ধার করে এনেছে এক মা। ওই নারীর লিবিয়া অভিযান যেন সিনেমার গল্পকে হার মানায়। লিবিয়ার ত্রিপলি বিজয়ের এ ঘটনা ঘটিয়েছেন কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের লিবিয়া প্রবাসী আবুল খায়েরের স্ত্রী শাহীনূর বেগম (৪৫)। লিবিয়া থেকে অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার পথে মাফিয়া চক্রের হাতে ধরা খেয়ে ছয় মাস ধরে বন্দি থাকা ছেলেকে উদ্ধার করে সম্প্রতি তিনি দেশে ফিরেছেন। সোমবার শাহীনুরের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে লোকজনের ভিড়। সবাই মা-ছেলেকে দেখতে আসছেন।
শাহীনুর বেগম ও
তার ছেলে ইয়াকুব হোসাইনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তাদের দুঃসাহসী অভিযানের কাহিনী। আবুল খায়ের স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই কন্যা সন্তান ফেলে প্রায় ১১ বছর আগে ২০১১ সালে দালালের মাধ্যমে পাড়ি জমান লিবিয়ায়। এরমধ্যে দুই কন্যার বিয়ে হয়ে যায়। অভাবের সংসারে আরও একটু স্বচ্ছলতা আনতে সপ্তম শ্রেনীতে পড়া অবস্থায় ২০১৯ সালের মে মাসে একমাত্র ছেলে ইয়াকুবও চলে যান লিবিয়ায়। ইয়াকুব প্রথম এক বছর ‘আল হারুজ’ নামে তেলের পাম্পে ৩৫ হাজার টাকা এবং পরে এক বছর হাকজিলতন তেলের পাম্পে ৪৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। বাবা-ছেলের আয়ে ভালোই চলছিল তাদের সংসার।
একপর্যায়ে আরও উন্নত জীবনের স্বপ্নে জাহাঙ্গীর নামে এক দালালের খপ্পরে পড়ে অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির পথ ধরেন ইয়াকুব। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলি থেকে বোটে করে ১৫০ জন ইতালি যাওয়ার পথে ল্যাম্ব-দোসা দ্বীপে ‘মাফিয়াদের’ হাতে ধরা পড়েন ইয়াকুব। সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য এক বাঙ্গলি দালাল ধরে বাবার সহযোগিতায় চার লাখ টাকায় মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেন ইয়াকুব।
দ্বিতীয় দফায় মাফিয়া চক্র তাদের লিবিয়ার কোস্টগার্ডের কাছে বিক্রি করে দেয়। কোস্টগার্ড তাদের অন্য একটি দ্বীপে দালালদের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেখানে চলে অমানবিক জীবন। একেকটি কক্ষে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ জনের অবস্থান। খাদ্যসংকট, শারীরিক নির্যাতনসহ নানা কারণে প্রায় প্রতিদিনই মারা যাচ্ছিলেন সঙ্গী-সাথিরা। লাশের পঁচা গন্ধ, পেটের ক্ষুধা, পানি সংকট আর টাকার জন্য চলে বন্দুকের বাটের আঘাত ও পানির পাইপের পিটুনি। শরীরের ক্ষত থেকে পচন ধরে ইয়াকুবসহ অন্যদের। এ সংবাদে তার বাবা আবুল খায়ের স্ট্রোক করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। খবর দেন দেশে স্ত্রী শাহীনুরকে। সঙ্গে সঙ্গে পাসপোর্ট এবং ভিসা লাগিয়ে লিবিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন শাহিনূর।
চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি লিবিয়ার উদ্দেশে পাড়ি দেন। স্বামীর সঙ্গে লিবিয়ার বেনগাজি অবস্থান করে দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে আইওএম’র কর্মকর্তা এবং সেনা সদস্যদের সহযোগিতায় ওখান থেকে অর্থের বিনিময়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনেন তারা। প্রায় ছয় মাসের বন্দি জীবন থেকে মুক্তি পান ইয়াকুব। শাহীনুর গত ৮ মার্চ বেনগাজি থেকে এবং ইয়াকুব ১৬ মার্চ ত্রিপলি থেকে ঢাকায় ফেরেন। লিবিয়া থেকে ফেরার পর তাদের রাখা হয় আশকোনার হজ ক্যাম্পে। ২১ মার্চ শাহীনুর ও ইয়াকুব ফেরেন নিজ বাড়িতে। শাহীনুর বেগম বলেন- সবাই বলছিল আমার ছেলে মারা গেছে,
তাকে মেরে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। চার দফায় ছেলেকে উদ্ধারের জন্য আমি ও আমার স্বামী দালালকে প্রায় ২০ লাখ টাকা দিয়েছি। ছয় মাসেও ছেলের কোনো খোঁজ না পেয়ে নিজেই লিবিয়া চলে যাই। বাংলা ভাষা জানেন এমন কয়েকজনকে খুঁজে বের করে তাদের কাছে সব বলি। তারা আমাকে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। দূতাবাস ও আইওএম’র কর্মকর্তারা সব শুনে আমাকে সাহায্য করেন। ইয়াকুব বলেন- আমাদের যেখানে রাখা হয়, সেখানে সাতজন বাংলাদেশি আমাদের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। তাদের একজনের নাম সুজন।
বাকিদের নাম আমার মনে নেই। তারাও মাফিয়াদের হাতে অনেক আগে ধরা পড়ে ছিলেন। তবে তারা মাফিয়াদের কিছুটা বিশ্বস্ত। এই সাতজন আমাদের নিয়মিত মারধর করতেন। কোনো কথা ছাড়াই হাতের কাছে যা পেতেন তা দিয়ে মারতেন। তাদের কোনো মায়া-দয়া ছিল না। তারাই আমাদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছেন। আমাদের ৩০০ জনের জন্য প্রতিদিন ৩০০টি রুটি দেওয়া হত। এই সাতজন ৩০টি রুটি রেখে বাকি ২৭০টি আমাদের দিতেন।
সেগুলো আমরা ভাগ করে খেতাম। ইয়াকুবের মা শাহীনুর বলেন, আইওএম কর্মকর্তারা লিবিয়া সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইয়াকুবকে উদ্ধার করেন। তারা ফোনে আমার সঙ্গে ওর কথা বলিয়ে দেন। ফোনে যখন ছেলের কণ্ঠ শুনি, তখন হাউমাউ করে কেঁদে ওঠি। আমার ছেলেও ওপাশ থেকে কান্না করতে থাকে। ছেলেকে দেখার জন্য বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু লিবিয়ায় আমাদের দেখা হয়নি। ছেলে তখন ত্রিপলিতে ছিল, আর আমি বেনগাজিতে। শাহীনুর আরও বলেন, আমাদের কাছ থেকে যারা টাকা নিয়েছেন, তাদের একজন এখন দেশে আছেন। তার বাড়ি হবিগঞ্জে।
আমি তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব। আমি যদি টাকাগুলো ফেরত পাই, তাহলে খুব উপকার হবে। আমি আইওএম-এর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। তারা আমার ছেলেকে উদ্ধার করে দিয়েছে।