বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে দেশে মূল্যস্ফীতির হার এখন গত নয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এমন অবস্থায় আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। খাবারের তালিকা থেকে দিন দিন ছাঁটাই করতে হচ্ছে পুষ্টিকর খাবার। সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীলরা মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার দাবি করলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন কথা বলছে। উল্টো বাজার দরে দফায় দফায় উল্লম্ফন ঘটলেও সে হারে মানুষের আয় বাড়েনি। এমনই একজন বেসরকারি চাকরিজীবী এনামুল হাসান; প্রতি বছর খরচের খাতা দীর্ঘ হলেও আয় একই রয়ে গেছে তার। ফলে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। এতে বাজার কাটছাঁট করেই চলতে হচ্ছে তাকে। মাছ ও ডিম খাওয়া এখন প্রায় স্বপ্নের মতো হয়ে গেছে। ইউক্রেইন ও রাশিয়া যুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতি যেভাবে অস্থির হয়ে ওঠেছে এর প্রভাবে বাংলাদেশেও দ্রব্যমূল্য লাগামহীন হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীকে কম দামে খাওয়ানোর জন্য সরকার টিসিবির মাধ্যমে চেষ্টা করে। তবে জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বমুখী দরে নাকাল হয় নিম্নবিত্তের জীবন। টিসিবির বাজার দর বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এক বছরে পেঁয়াজ, আমদানি করা রসুন এবং আদা ছাড়া সব নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন বেড়েছে। চলতি মাসের বাজারদরে দেখা গেছে, এক বছরের ব্যবধানে চিকন চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ১৫ শতাংশ। মাঝারি চাল প্রায় ৯ শতাংশ এবং মোটা চালের দাম ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া খোলা আটা ৩২ শতাংশ, প্যাকেট আটা ৫২ শতাংশ, খোলা ময়দা প্রায় ৫১ শতাংশ, প্যাকেট ময়দা ৫৪ শতাংশ বেশি দামে কিনতে হয়। মানভেদে মসুর ডালের দর বেড়েছে ২৬ থেকে ৪৪ শতাংশ, মুগ ডালের দাম বেড়েছে প্রায় ৪ শতাংশ। ব্রয়লার মুরগী বেড়েছে ৯ শতাংশেরও বেশি। ডিমের দাম বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ, আলুর ১৯ শতাংশ ও চিনির ১৬ শতাংশ বেড়েছে। এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়া মে মাসের ভোক্তা মূল্যসূচকের (সিপিআই) হালনাগাদে এ তথ্যে দেখা যায়, এক মাসের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতি দশমিক ৭ ভাগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। একইসময়ে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হারও বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। গত মে মাসে তা ছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। এ হার গত নয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিবিএস জানায়, খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি পেয়ে ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ হয়েছে। গত মাসেও তা ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ মে মাসের তুলনায় জুন মাসে সব খাতেই মূল্যস্ফীতির হার বেশি। সরকারি এ সংস্থার তথ্যে দেখা যায়, পয়েন্ট টু পয়েন্ট এর ভিত্তিতে মে মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয় ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। এর অর্থ; ২০২১ সালের মে মাসে যে পণ্যের জন্য ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, ২০২২ সালের মে মাসে একই পণ্য কিংবা সেবার জন্য ১০৭ টাকা ৪২ পয়সা খরচ করতে হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ব্যয় বাড়ায় কৌশল করে পরিবার নিয়ে জীবন চালাচ্ছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব আমিনুল। রাজধানীর কল্যাণপুরে ফ্ল্যাট বাসায় ড্রয়িং ও ডাইনিংকে রুম বানিয়ে পরিবার নিয়ে থাকছেন তিনি। সপ্তম শ্রেণিতে পড়া ছেলের বেতন ও টিউশনসহ মাসের খরচ প্রায় ৩ হাজার টাকা। একই ক্লাসে পড়া মেয়ের খরচও সমান। তিনি বলেন, ‘মাসের অর্ধেক হতেই বেতন শেষ। অতিরিক্ত কিছু ইনকামে খাবারের ব্যবস্থা হয়, পুরো মাস চলতেও হয়। স্ত্রীর সেলাইয়ের কাজের কিছু ইনকামে কিছুটা চলা যায়। আগে দুধ খেতেন মাঝে মধ্যে, এখন তার চেহারা দেখাই বন্ধ। এখন ডিমও বেশি দিন খাওয়া হয় না। সবজি এখন একমাত্র ভরসা।’ মিরপুরে বাসিন্দা সুমন আলী গার্মেন্টসের সুইং সেকশনে কাজ করে পান ১০ হাজার টাকা। সীমিত আয়ে পরিবারের সদস্যদের খাবার পর্যাপ্ত হচ্ছে না, তাদের শরীর ‘দুর্বল’ হচ্ছে, তা বুঝছেন সুমন। কিন্তু তার এখন ‘কিছু করার রাস্তা নেই। মৌসুমী ফলের মূল্যও নাগালের বাইরে।’ সংসারে খাবারের তালিকায় কীভাবে কাটছাঁট করে চলছে, তা দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘আগে ডিম খাইতাম, এখন তাও কমায় দিছি। পাঙ্গাস মাছ খাইতাম, এটার দামও এখন দেড়শ টাকার বেশি। তারপরও কম দামে মাছ পাইলে সপ্তাহে দুই দিন খাইতে পারি।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক পুষ্টিবিদ অধ্যাপক খালেদা মনে করেন, ‘মানুষের আয়ের চেয়ে সামঞ্জস্যহীনভাবে খরচ বেড়ে যাওয়ায় এখন সবচেয়ে বেশি ঘাটতি হচ্ছে ‘প্রোটিনে’। যে খাবারগুলোর দাম অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে সেগুলো এখন খেতে পারছে না মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা।’