হায়দার হোসেন গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি :
গোপালগঞ্জে জোয়ারের পানি ও শ্রমিক সংকটের কারণে ধান কাটতে না পেরে দিশেহারা হয়ে পড়েছে চান্দার বিল এলাকার প্রায় ১৫ হাজার কৃষক পরিবার। এমবিআর ক্যানেলের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ থাকায় মাত্রাতিরিক্ত পানি বেড়ে গিয়ে তলিয়ে যেতে বসেছে চান্দার বিলের প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান।
বিলবেষ্টিত ওই এলাকার রাস্তাঘাটগুলোর অবস্থা করুণ। বিল-অভ্যন্তরে যাতায়াত-ব্যবস্থা নেই। হার্ভেস্টার মেশিনও সেখানে যেতে পারে না। ধানকাটা-শ্রমিকরাও যেতে চান না বা গেলেও মজুরি ১২ শ’ টাকা বিধায় শ্রমিক সংকটও রয়েছে পুরোপুরি। বাধ্য হয়ে কৃষক-পরিবারগুলো নিজেরাই যতটুকু সম্ভব ক্ষেতের কাঁচা ও আধাপাকা ধানই তারা কাটতে শুরু করেছেন।
গোপালগঞ্জের মোট উৎপাদিত ধানের একটি বড় অংশ উৎপাদিত হয় এক ফসলী এ চান্দার বিল থেকে। বিলের চারিদিকে রয়েছে জেলার মুকসুদপুর, কাশিয়ানী ও সদর উপজেলার ৬ ইউনিয়ন। এলাকার ৯৫% মানুষ নির্ভরশীল এ বিলে উৎপাদিত বোরো ধানের উপর।
সরেজমিন গেলে ভুক্তভোগীরা জানান, বিগত কয়েক বছর এ সময়টাতে এমবিআর ক্যানেলের থেকে জোয়ারের পানি ঢুকে বিলের কৃষিজমি তলিয়ে যায়। প্রতিবছরই জোয়ারের পানির পরিমান বাড়ছে। এবছর জোয়ারের পানি মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় চরম বিপদের সম্মুখিন হয়েছে এলাকার মানুষ।
এলাাকার কৃষক মিল্টন বিশ^াস জানান, চান্দার বিলে তার ২০ বিঘা জমির ধান এখন জলের নিচে। একজন শ্রমিককে পাঁচের-এক অংশ ধান ও তিনবেলা খাবার দিয়েও তিনি শ্রমিক পাচ্ছেন না; ধানও কাটতে পারছেন না। চান্দারবিল-সংলগ্ন বড়বিলে তার ১৭ বিঘা জমির ধান জোয়ারের চাপে পড়ে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। আমি সর্বশান্ত হয়ে গেছি।
আরিফ উকিল নামে আরেক কৃষক জানান, প্রতিবছরই জোয়ারের পানি ঢুকে ধান তলিয়ে যায়। তার ৪ বিঘার জমির ধান কোনবারই তিনি পুরোটা কেটে বাড়ি নিতে পারেননি। কৃষাণের দাম অতিরিক্ত হওয়ায় তিনি কৃষাণও নিতে পারেন না। আধাআধি থেকে যায়। পানির ভিতর দিয়ে ধানের বোঝা মাথায় নেয়া যায় না। ধান বিক্রি করতে গেলে মনপ্রতি সাড়ে ৬ শ’ বা ৭ শ’ টাকার বেশি পাওয়া যায় না। তিনি খুবই দুর্দশার মধ্যে আছেন।
কৃষক সিদ্দিক মোল্যা জানিয়েছেন, চান্দার বিলে তার ৪ বিঘার জমির ধান পানির নিচে পড়ে গ্যাজ (শিকড়) হয়ে গেছে। প্রায় ৩ কিমি দূর থেকে কেটে বোঝা বয়ে আনার উপায় নেই; নৌকাও সেখানে যায় না। এখন পলিথিনে করে পানির ভিতর দিয়ে টেনে নিয়ে আসতে হচ্ছে। শ্রমিক দিয়ে আনতে গেলে ধানের খরচও উঠবে না।
এই একটি ফসলের উপরই আমাদের এলাকার সবাই নির্ভরশীল। আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়েছি। সরকার যেন আমাদের দিকে একটু খেয়াল করে।
মুকসুদপুরের উজানী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কৃষিবিদ শ্যামল কান্তি বোস জানিয়েছেন, চান্দার বিলের সঙ্গে ‘বড় বিল’ নামে আরেকটি বিল রয়েছে; যেটি একসময় চান্দার বিলেরই অংশ ছিল। এবছর প্রত্যেকটি বিলেই বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু জোয়ারের পানি কৃষকদের সব স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে।
বিলের মধ্যে ১৫টি খাল রয়েছে। এসব খাল দিয়েই মূলত: জোয়ারের পানি বিলে প্রবেশ করে। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি খাল খনন ও সেগুলির মুখে ¯øুইস গেট স্থাপন করতে পারলে জোয়ারের পানি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। এছাড়াও বোসের খাল নামে আরেকটি খাল রয়েছে; যেটির পশ্চিমপাড় দিয়ে বেড়িবাঁধ রয়েছে। এখন খালটির পূর্বপাড় দিয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে পারলে বিলের পশ্চিম প্রান্তের জমি জোয়ারের পানি থেকে রক্ষা পাবে।
গোপালগঞ্জ কৃষি-সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. অরবিন্দু কুমার রায় জানিয়েছেন, বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষকদেরকে এব্যাপারে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। শ্রমিক সংকট নিরসনের চেষ্টা চলছে। অধিকাংশ খাল ভরাট হয়ে আছে। জমিগুলো নিচু হওয়ায় একবার পানি উঠে গেলে সহজে নামে না।
হার্ভেস্টার মেশিনও সেখানে যেতে পারে না। চান্দার বিলের মধ্যে রাস্তা করা গেলে জমি থেকে ধান আনা-নেয়ার সমস্যাও কমে যাবে। পরবর্তী জেলা কো-অর্ডিনেশন মিটিংয়ে বিষয়টি তুলে ধরা হবে এবং এসব সমস্যা থেকে উত্তোরণের ব্যবস্থা নেয়া হবে।