একজন ছোট্ট জাদুকর যে ১১০ মিটার দীর্ঘ এবং ৪৯ মিটার চওড়া সবুজ ক্যানভাসে চিত্রকর্ম করে চলেছেন দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে, একজন দক্ষ শিল্পীর মতো তার পায়ে কল্পনার মাধুর্য মিশিয়ে। একজন ছোট্ট জাদুকর যে ১১০ মিটার দীর্ঘ এবং ৪৯ মিটার চওড়া সবুজ ক্যানভাসে চিত্রকর্ম করে চলেছেন দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে, একজন দক্ষ শিল্পীর মতো তার পায়ে কল্পনার মাধুর্য মিশিয়ে। উচ্চতা মাত্র ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি; কিন্তু কী অসম্ভব গতি, তার ক্ষিপ্রতা চিতার মতো। কিছু দিন আগে, একটি লাতিন আমেরিকান পত্রিকা রিপোর্ট করেছিল যে ফুটবলের মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রটি তার এত ছোট যে এটি অন্য ডিফেন্ডারদের ধরে রাখা বা থামানো অসম্ভব। ফুটবলের রাজপুত্র কিংবা ছোট জাদুকর- অনেক নামেই ডাকা হয় তাকে। সবাই জানে তিনি বিশ্বের সেরা ফুটবলার। ক্লাব ফুটবলে হাজারো সাফল্য যার পদতলে এসে সমর্পিত হয়েছে। কিন্তু একা কোপা আমেরিকা ছাড়া আর্জেন্টিনার জার্সিতে জাতীয় দল এখনো কিছু অর্জন করতে পারেনি। এতক্ষণে বুঝে যাওয়ার কথা, কার কথা বলা হচ্ছে। হ্যাঁ, তিনিই লিওনেল মেসি। আজ তার ৩৫তম জন্মদিন। অর্থ্যাৎ ৩৫টি বসন্ত পেরিয়ে ৩৬-এ পা দিয়েছেন পিএসজিতে খেলা আর্জেন্টাইন এই ফুটবল বিস্ময়। আর্জেন্টিনার মধ্যাঞ্চলীয় রাজ্য সান্তা ফে’র সবচেয়ে বড় শহর রোজারিও। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সের ৩০০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত রোজারিও শহর। এই শহরেই ১৯৮৭ সালের আজকের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। বাবা হোর্হে মেসি ছিলেন একটি ইস্পাতের কারখানার ম্যানেজার। তার মায়ের নাম সেলিয়া মারিয়া কুচ্চিত্তিনি। যিনি একটি চম্বুক উৎপাদনকারী কারখানায় কাজ করতেন। তাদের ঘরের তৃতীয় সন্তান হলে লিওনেল মেসি। বাবার দিক থেকে মেসি ছিলেন ইতালিয়ান এবং স্প্যানিশ – মিশ্র বংশোদ্ভূত। মায়ের দিক থেকে আবার পুরোপুরি ইতালিয়ান বংশোদ্ভূত। মেসিদের পৈতৃক পরিবারের আদি নিবাস ছিল ইতালির আকোনা শহরে। তার পূর্বপুরুষদের একজন অ্যাঞ্জেলো মেসি সেখান থেকে আর্জেন্টিনায় চলে আসেন।মেসির বড় দুই ভাই এবং একটি ছোট বোন রয়েছে। বড় দুই ভাইয়ের নাম রদ্রিগো ও মাতিয়াস মেসি এবং ছোট বোনের নাম মারিয়া সল। পাঁচ বছর বয়সে মেসি স্থানীয় ক্লাব গ্রান্ডোলির হয়ে ফুটবল খেলা শুরু করেন, যার কোচ ছিলেন তারই বাবা হোর্হে। ১৯৯৫ সালে মেসি রোজারিও ভিত্তিক ক্লাব নিওয়েল’স ওল্ড বয়েজে যোগ দেন। ১১ বছর বয়সে মেসির গ্রোথ হরমোনের সমস্যা ধরা পড়ে। যার চিকিৎসা ছিল ব্যায়বহুল। আর্জেন্টাইন ক্লাব রিভার প্লেট মেসির প্রতি তাদের আগ্রহ দেখালেও সে সময় এই ব্যায়বহুল চিকিৎসার খরচ বহন করতে অপারগ ছিল। মেসির চিকিৎসার জন্য প্রতিমাসে প্রয়োজন ছিল ৯০০ মার্কিন ডলার করে। এ সময় আর্জেন্টিনা অবস্থান করছিলেন বার্সেলোনার তৎকালীন ক্রীড়া পরিচালক কার্লোস রেক্সাস। তিনি মেসির প্রতিভা সম্পর্কে জানতে পারেন এবং তার খেলা দেখে মুগ্ধ হন। ঠিক যেমন বলে রতনে রতন চেনে। ওই সময়ই মেসিকে নিয়ে তিনি চুক্তি সেরে ফেলতে চান এবং হাতের কাছে কোন কাগজ না পেয়ে একটি ন্যাপকিন পেপারে তিনি মেসির বাবার সাথে চুক্তি সাক্ষর করেন। বার্সেলোনা মেসির চিকিত্সার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করতে রাজি হয়। এরপর মেসি এবং তার বাবা বার্সেলোনায় পাড়ি জমান। সেখানে মেসিকে বার্সেলোনার ফুটবল একাডেমি লা মাসিয়ায় ভর্তি করে দেয়া হয় এবং একই সঙ্গে চলে তার হরমোনের চিকিৎসা। বার্সার হয়ে পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু করেন ২০০৪ সালে। অভিষেকের পর থেকে তো আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক সাফল্য এসে ধরা দিয়েছে মেসির হাতে। লা লিগা, কোপা ডেল রে, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ক্লাব বিশ্বকাপ- কোনোটাই বাদ যায়নি। ব্যক্তিগত সেরার পুরস্কার জিতেছেন সবচেয়ে বেশি। সাত-সাতটি ব্যালন ডি’অর। চাট্টিখানি কথা নয়। ২০২১ সালে এসে আর মেসিকে ধরে রাখতে পারেনি বার্সেলোনা। বার্সার সঙ্গে প্রায় ২২ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে মেসি যোগ দেন ফরাসী ক্লাব পিএসজিতে। জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক ২০০৫ সালে। তার সামনে সুযোগ ছিল স্পেনের হয়েও খেলার। কিন্তু নিজ দেশকেই বেছে নেন তিনি। এরপর থেকে এখনও পর্যন্ত আর্জেন্টিনার হয়ে ১৬২টি ম্যাচ খেলেছেন এবং দেশটির হয়ে সর্বোচ্চ ৮৬টি গোল করেছেন। দলকে একবার বিশ্বকাপের ফাইনালে তুলেছেন। কোপা আমেরিকার ফাইনালে তুলেছেন তিনবার। এর মধ্যে সর্বশেষ ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা আমেরিকার শিরোপা জয় করেছে মেসির আর্জেন্টিনা। মেসির ৩৫তম জন্মদিন এমন এক সময়ে পালন করা হচ্ছে, যখন তার সামনে বিশ্বকাপ জয়ের সুবর্ণ সুযোগ। দুর্দান্ত একটি দল নিয়ে আগামী বিশ্বকাপে লড়াই করতে নামবে আর্জেন্টিনা। তার জন্মদিনে ভক্তদের চাওয়া অন্তত একটি বিশ্বকাপ।